Connect with us

স্মার্ট প্যারেন্টিং

শিশু এবং কিশোরদের উপর ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব

ডা: মৌমিতা পাল

শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
এম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )
এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)

সব দিকে এখন প্রযুক্তির জয়জয়কার। স্মার্টফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে টেলিভিশন এবং ট্যাবলয়েড বেইসড খেলনা সবকিছুতেই শিশু এবং কিশোরেরা প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি দিয়ে আচ্ছন্ন। বাস্তবতা হচ্ছে শিশু এবং কিশোরদের প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের যোগ্যতা অর্জন, শিক্ষা,দক্ষতা অর্জনের জন্য যেমনটা প্রয়োজন, ঠিক তেমনভাবে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার প্রভাব ফেলছে তাদের শরীর এবং মনস্তত্ত্বের ওপর।

impact-of-electronic-devices-on-children-and-teens

এই প্রভাব হতে পারে, চোখের সমস্যা, স্থূলতা,অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে সামাজিক দক্ষতা এবং আচরণগত সমস্যা, কিংবা ঘুম এবং স্মৃতি শক্তির সমস্যা ।

যেহেতু প্রযুক্তি আমাদের, দৈনন্দিন জীবনের  একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে, এবং অনেক কিছুই প্রযুক্তি নির্ভর, সুতরাং পিতামাতারা হয়তো প্রযুক্তিকে তাদের সন্তানের জীবন থেকে একদমই ব্যান করে দিতে পারবেন না, কিন্তু তাদের উচিত হবে, অতিরিক্ত সতর্কতা এবং সচেতনতার সহিত সেই প্রযুক্তির ব্যবহারকে তাদের সন্তানের মধ্যে চালনা করা।

কীভাবে প্রযুক্তি শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে প্রভাব ফেলে

শিশুদের স্থূলতা এবং প্রযুক্তি:

শিশু এবং কিশোররা যখন ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাইরের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, মাঠে খেলাধুলা, শারীরিক ব্যায়াম এগুলা আর হয়ে ওঠে না। ফলশ্রুতিতে হয়ে যায় স্থূলতা। পাশাপাশি অনেক গবেষণা এটাও বলে যে, অতিরিক্ত মোবাইল কিংবা টেলিভিশন দেখিয়ে যখন আমার শিশু এবং কিশোরদেরকে খাওয়ানোতে ব্যস্ত রাখি, তখন তাদের “মাইন্ডফুল ইটিং” থেকে তারা ব্যাহত হয়। যা পরবর্তীতে আরো স্থুলতাকে ত্বরান্বিত করে।

সুতরাং শিশু এবং কিশোরদের প্রযুক্তি নির্ভরতা কে, একদম অবাঞ্ছিত না করে, উচিত হবে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু ব্যবহার করা, বাইরের খেলাধুলা কিংবা শারীরবৃত্তীয় কাজগুলোকে উৎসাহিত করা।

টেকনোলজির প্রভাবে শিশু এবং কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা:

প্রযুক্তির উন্নয়নের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো সামাজিক দক্ষতা। একটি গান আমরা সবাই জানি পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে ‘স্যাটেলাইট আর ক্যাবলের হাতে, ড্রয়িং রুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী”। ঠিক তেমনি পৃথিবীটা যেমন আমাদের হাতে বন্দি, আমাদের সমাজ পরিবার সবকিছুই যেন এই মুঠোফোন কিংবা এই ডিভাইসের মধ্যেই যেন সবকিছু বন্দী। এতে করে শিশু এবং কিশোরদের পারস্পরিক সম্পর্ক কিংবা সামাজিক দক্ষতা খুব কঠিন ভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এতে করে শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে, কীভাবে সামাজিক পরিবেশে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হয় সেটা শিখতে পারছে না, বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি কিংবা রক্ষা করতে পারছে না।

এমনকি সমবয়সি বন্ধুদের সাথেও বন্ধুত্ব তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছে।

সুতরাং এই ক্ষেত্রে পিতা মাতার ভূমিকা হচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহার একটি নির্দিষ্ট লিমিটের মধ্যে নিয়ে আসা, পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় করা। যেমন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় পরিবারের সদস্যরা একই সাথে বসে দুপুরের খাবার খাবে, একসাথে বসে গল্প করবে, ছুটির দিনে বেড়াতে যাবে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করবে, সমবয়সি বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করবে ইত্যাদি।

ভুলে গেলে চলবে না, শিশু এবং কিশোররা অনুকরণ প্রিয়। তারা তাই শিখে যা তারা দেখে, তাই তাদেরকে সেই অভ্যাসে তৈরি করতে হলে পিতা-মাতাকেও সেভাবেই রুটিন সাজিয়ে নিতে হবে

প্রযুক্তি এবং মনোযোগ

গবেষণা বলে অতিরিক্ত প্রযুক্তি এবং ডিভাইসের ব্যবহার, শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি ঘটায়।

স্ক্রিনে চলতে থাকা অনবরত রিলস কিংবা শর্টস যখন শিশু-কিশোররা দেখে, একটা নির্দিষ্ট কোন কিছুতে তারা তাদের মস্তিষ্ককে তখন স্থির করতে পারে না, ঠিক একইভাবে তারা তাদের মনোযোগ টাকেও স্থির করতে পারে না, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে স্থায়ী  হয়ে যায় সেই মনোযোগের ঘাটতি।

পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তির প্রভাব :

এটা আমরা অস্বীকার করতে পারবো না যে, এখন ছয় মাস বয়স থেকে শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস।

এতে করে ঠিক যে বয়সে তাদের সামাজিক যোগাযোগ এর ক্ষমতা বেড়ে ওঠার কথা সেটা ব্যাহত হয়। শিশুরা দেরিতে কথা বলতে শিখে, কিংবা কথা বলতে শিখলেও তো অস্পষ্ট হয় কিংবা মনের ভাবকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না

তাছাড়া অল্প বয়সেই শুরু হয়ে যায় চোখের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, আচরণ গত সমস্যা।

ঠিক কত সময় প্রযুক্তির ব্যবহারকে আমরা অতিরিক্ত বলবো?

আমেরিকান একাডেমি অফ চাইল্ড এন্ড অ্যাডোলসেন্ট সাইকিয়াট্রি (AACA) এর মতে বিশ্বব্যাপী কিশোরেরা প্রতিদিন গড়ে ৯ ঘণ্টার বেশী স্ক্রিন টাইম ইউজ করছে। এবং ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম ইউজ করছে।

“মায়ো ক্লিনিকের” পরামর্শ মতে দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের স্ক্রিন টাইম প্রতিদিন এক ঘণ্টা বা তার কমে নিয়ে আসা উচিত।

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (AAP) অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু এবং কিশোরদের পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানদের স্ক্রিনটাইম একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

Continue Reading
1 Comment

1 Comment

  1. Pingback: স্পিচ ডিলে বা শিশুর কথা বলার দেরির কারণ ও সমাধান — Parenting Point

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

স্মার্ট প্যারেন্টিং

স্পিচ ডিলে বা শিশুর কথা বলার দেরির কারণ ও সমাধান

ডা: মৌমিতা পাল

শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
এম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )
এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)

প্রযুক্তির এই যূগে ইদানীং কালে দেড় বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর পিতা-মাতাদের একটি কমন কনসার্ন হলো স্পিচ ডিলে। স্পিচ ডিলে (Speech Delay) বলতে বোঝায় শিশুর বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাষা বা কথা বলার দক্ষতা অর্জনে বিলম্ব হওয়া। এটি সাধারণত তখন বোঝা যায় যখন একটি শিশু নির্দিষ্ট বয়সে কথা বলা বা শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে অন্যান্য শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকে।

speech delay

কিন্তু অনেক সময় পিতা-মাতারা বুঝে ওঠেন না কখন বা কোন বয়সে এবং ঠিক কতটুকু কথা বলতে না পারার সীমাবদ্ধতা থাকলে তাকে স্পিচ ডিলে বলা হয়।

কোন বয়সে কতটুকু কথা বলতে বা শব্দ জানতে পারা দরকার সেটা বোঝার আগে আমাদের জানতে হবে কতটুকু কথা বলার সীমাবদ্ধতা থাকলে আমরা তাকে স্পিচ ডিলে বলবো।

এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

১. মিডিয়ান এজ (Median Age)

অর্থাৎ যে বয়সে ৫০% বাচ্চাদের তাদের বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট ভাষাগুলো বা শব্দগুলো শিখে ফেলা উচিত।

২. লিমিট এজ (Limit Age)

অর্থাৎ যে বয়সে ৯৭.৫% বাচ্চাদের তাদের বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ শিখে ফেলা উচিত।


বয়স এবং শব্দের সংখ্যা অনুযায়ী শিশুর সক্ষমতা:

১. বাবলিং (Babbling)

বাবলিং হলো শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক মাসে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন ধ্বনি তৈরি করার পর্যায়, যা ভাষা শেখার প্রাথমিক ধাপ। এ সময় শিশুরা বাবা-মা অথবা আশেপাশের পরিবেশ থেকে আওয়াজ শুনে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। উদাহরণ: “বাব্বা”, “দা-দা”।

  • মিডিয়ান এজ: ৪-৬ মাস (শতকরা ৫০% শিশুর এই দক্ষতা অর্জন করা উচিত)।
  • লিমিট এজ: ৯ মাস (শতকরা ৯৭% শিশুর এই দক্ষতা অর্জন করা উচিত)।

গবেষণা বলে, প্রথম ৯ মাসের মধ্যে যদি বাবলিং না থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ এটি হিয়ারিং প্রবলেম বা ডেভেলপমেন্টাল ডিলের লক্ষণ হতে পারে।


২. প্রথম শব্দ:

যেমন “মা”, “বাবা”, “দাদা”।

  • মিডিয়ান এজ: ১২ মাস।
  • লিমিট এজ: ১৮ মাস।

৩. দুই শব্দের বাক্য গঠন:

যেমন “মা দাও”, “জল খাও”।

  • মিডিয়ান এজ: ২৪ মাস (২ বছর)।
  • লিমিট এজ: ৩০ মাস (আড়াই বছর)।

৪. অর্থবহ শব্দ বলা:

  • ১০-২০ শব্দ: ১৮ মাস (মিডিয়ান এজ)।

  • ৫০ শব্দ:

    • মিডিয়ান এজ: ২৪ মাস।
    • লিমিট এজ: ৩৬ মাস।
  • ২০০-৩০০ শব্দ:

    • মিডিয়ান এজ: ৩৬ মাস।
    • লিমিট এজ: ৪২-৪৮ মাস।

৫. বাক্য তৈরি করা:

তিন শব্দের বাক্য যেমন “আমি জল খাবো”।

  • মিডিয়ান এজ: ৩৬ মাস।
  • লিমিট এজ: ৪২ মাস।

৬. স্পষ্টভাবে কথা বলা:

  • ৭৫% বোধগম্য করে কথা বলা:

    • মিডিয়ান এজ: ৩৬ মাস।
    • লিমিট এজ: ৪৮ মাস।
  • ১০০% বোধগম্য করে কথা বলা:

    • মিডিয়ান এজ: ৪৮ মাস।
    • লিমিট এজ: ৬০ মাস।

স্পিচ ডিলের কারণ:

  • শারীরিক বা মুখমণ্ডলের গঠন গত সমস্যা ( ক্লেফট লিপ, ক্লেফট প্যালেট ইত্যাদি)
  • শ্রবনশক্তির সীমাবদ্ধতা
  • অন্যান্য নিউরোডেভেলপ মেন্টাল সমস্যা ( যেমম অটিজম, ল্যাংগুয়েজ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি)
  • জন্মগত ত্রুটি যেমন সেরেব্রাল পালসি
  • বিভিন্ন সিন্ড্রোমিক ডিসঅর্ডার
  • বিভিন্ন পারিবারিক বা পরিবেশগত কারণ
  • গর্ভকালীন জটিলতা বা ইনফেকশানের ইতিহাস ( যেমন, রুবেলা, টক্সপ্লাজমা, বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহন , ধূমপান, মদ্যপান ইতাদি)
  • বিকাশের জন্য বা কথা শেখানোর  জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন বা চেষ্টার ঘাটতি ইত্যাদি।

চিকিৎসা ও করণীয়:

  • যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্ভব সমস্যা নির্ধারণ এবং তা মূল্যায়ন করা : এই ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ  চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি যেমন পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট কিংবা চাইল্ড সাইক্রিয়াট্রিস্ট, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট/ স্পিড থেরাপিস্ট
  • স্পিচ থেরাপি: এটি স্পিচ ডিলে সমস্যার একটি অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। যেখানে একজন ট্রেন্ড থেরাপিস্ট বাচ্চাকে তার সমস্যা অনুযায়ী থেরাপি বা প্রশিক্ষণ দিবে
  • পরিবার এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত কথা বলা কিংবা অভিব্যক্তি বুঝানোর চেষ্টা করা,শিশুর সাথে কথা বলা গল্প বলা বিভিন্ন রকমের ইন্টারেকশন করা
  • অন্যান্য সমস্যা যেমন শারীরিক ত্রুটি কিংবা শ্রবণ শক্তির সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটার চিকিৎসা করা
  • অন্যান্য স্নায়ু বিকাশ জনিত সমস্যা যেমন সেরেব্রাল পালসি এডিএইচডি/ বা অন্যান্য জেনেটিক ডিসঅর্ডার থাকলে সেটার সিম্পটমস অনুযায়ী চিকিৎসা করা

সর্বোপরি পিতা-মাতার এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ধৈর্য ধারণ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা এবং নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা এই সমস্যার সমাধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে


রেফারেন্স:
Singapore Medical Journal

Continue Reading

স্মার্ট প্যারেন্টিং

নবজাতকের মানসিক, ইমোশনাল এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ: একটি অন্তর্দৃষ্টি

ডা: মৌমিতা পাল

শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
এম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )
এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)

নবজাতকের জন্মের পর থেকেই তার শারীরিক বিকাশ যেমন চোখে পড়ে, তেমনি মানসিক, আবেগিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। নবজাতক তার আশেপাশের পরিবেশ, মানুষের আচরণ, এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে ঘটে এবং প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন উপাদান প্রভাব ফেলে।

child development

মানসিক বিকাশ: নবজাতকের মানসিক বিকাশের শুরু হয় তার জন্মের পর থেকেই। প্রথম ৬ মাসের মধ্যে নবজাতক তার মা-বাবা এবং অন্যান্য পরিচিত মানুষের সাথে মানসিক বন্ধন গড়ে তোলে। এই সময় তার ব্রেনের নিউরোনাল কানেকশন দ্রুত বিকাশ লাভ করে। সঠিক যত্ন এবং ভালবাসা এই সময় শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়। বিশেষ করে, মায়ের সাথে ত্বক-স্পর্শ (skin-to-skin contact) শিশুর ব্রেনের সঠিক বৃদ্ধি এবং মানসিক স্থিতিশীলতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইমোশনাল বিকাশ: নবজাতকের ইমোশনাল বা আবেগিক বিকাশ তার আশেপাশের পরিবেশ এবং পরিবার থেকে প্রাপ্ত অনুভূতির মাধ্যমে হয়। প্রথমদিকে, শিশু শুধুমাত্র কেঁদে তার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে। তবে ধীরে ধীরে সে বিভিন্ন ধরণের আবেগ প্রকাশ করতে শেখে, যেমন- হাসি, বিরক্তি, বা আতঙ্ক। শিশুর আবেগিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাবা-মার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্নেহময় সম্পর্ক ও স্থিতিশীল পরিবেশ শিশুর আবেগিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।

মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ: নবজাতকের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সাথে কথা বলা, গান শোনানো, এবং গল্প বলা তার ভাষাগত এবং চিন্তনক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে। এমনকি একতরফা কথা বললেও শিশুর ব্রেন ধীরে ধীরে শব্দ, ভাষা এবং অর্থ বোঝার ক্ষমতা তৈরি করতে শুরু করে। এছাড়াও, নিয়মিত চাহিদা পূরণ এবং স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুর আত্মবিশ্বাস এবং নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়।

কেন এই বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ?

শিশুর প্রথম বছরগুলির অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যতের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতায় প্রভাব ফেলে। এই সময়টিতে সন্তানের বিকাশের সঠিক যত্ন নিলে সে ভবিষ্যতে মানসিকভাবে আরও স্থিতিশীল, আবেগিকভাবে শক্তিশালী, এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে সৃজনশীল হয়ে উঠবে। তাই, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সন্তানের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি তার মানসিক ও আবেগিক বিকাশেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

কীভাবে সঠিকভাবে যত্ন নেয়া যায়?

সন্তানের সাথে সময় কাটানো: সন্তানের সাথে কথা বলা, তার অনুভূতির প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং নিয়মিত শারীরিক স্পর্শ তার বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

সঠিক পুষ্টি: সন্তানের সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা তার ব্রেন এবং মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

আনন্দময় পরিবেশ: আনন্দদায়ক এবং নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ শিশুকে নিরাপত্তাবোধ প্রদান করে, যা তার আবেগিক স্থিতিশীলতায় সহায়তা করে।

সুতরাং, নবজাতকের মানসিক, আবেগিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য সন্তানের প্রতি পিতামাতার মনোযোগ এবং ভালোবাসা সবচেয়ে বড় অবলম্বন।

নবজাতকের মানসিক, আবেগিক, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ধাপে ধাপে ঘটে, যা প্রতিটি বয়সের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

নিচে বয়সভিত্তিক কিছু সাধারণ বিকাশের ধাপ তুলে ধরা হলো:

child development chart
Continue Reading

স্মার্ট প্যারেন্টিং

শিশুরা খেতে না চাইলে কি করবেন

প্রায় প্রত্যেক মায়ের এই অভিযোগ আমার বাচ্চা কিছু খেতে চায় না। সারা দিন খাবার না দিলে না খেয়েই থাকে। আবার জোর করে খাওয়ালে বমি করে দেয়। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মা–বাবারা এই সমস্যা নিয়ে শিশুবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। শিশু খেতে চায় না, এটি  কি আদতেই জটিল সমস্যা? নাকি সাধারণ ব্যাপার?

feeding-problems

জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শিশু শুধু বুকের দুধ খায়। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তি খাবার শুরু করা হয়। এ সময় যদি শিশুকে সঠিক নিয়মে খাবার না দেয়া হয় তাহলে শিশুরা খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বা অনীহা প্রকাশ করতে থাকে। যেমন—

  • শিশুরা যদি বাইরের খাবারের অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে ঘরে তৈরি খাবার খেতে চায় না।
  • একই খাবার প্রতিদিন দেওয়া, এতে শিশু একঘেয়েমিতে ভোগে।
  • খাবারের ঘনত্ব ঠিক না থাকা। খুব বেশি তরল বা একদম ব্লেন্ড করা খাবার দিলে শিশু খাবারের স্বাদ পায় না। আবার বেশি শক্ত বা থকথকে দিলে গিলতে পারে না।
  • বুকের দুধের পরপর বাড়তি খাবার দেওয়া। শিশুদের পাকস্থলী আকারে বেশ ছোট, দুধই তাদের পেটের অনেকখানি ভরিয়ে ফেলে। তাই এ সময় বাড়তি খাবারটা খেতে পারে না।
  • ঘন ঘন এক–দুই ঘণ্টা পরপরই খাবার দেওয়া। এতে শিশু খাবারটুকু হজমের সময় পায় না, অনেক সময় বমিও করে দেয়।

১ থেকে ২ বছরের শিশুরা সাধারণত দুরন্ত প্রকৃতির হয়। খাবারের চেয়ে খেলাধুলা ও চঞ্চলতা বেশি করে। তাই বসিয়ে খাবার খাওয়ানো মুশকিল হয়ে যায়। তা ছাড়া এ বয়সে শিশুরা যদি চকলেট, চিপস, জুস—এ ধরনের বাইরের খাবারের অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে ঘরে তৈরি খাবার খেতে চায় না।

যা করবেন

১. শিশুদের খাবারের একটি রুটিন তৈরি করুনঃ ৬ থেকে ৯ মাসের শিশুরা বুকের দুধের পাশাপাশি দিনে দুবার আধা বাটি পরিমাণ বাড়তি খাবার খেলেই যথেষ্ট। বুকের দুধের পাশাপাশি ধীরে ধীরে ১-২ চামচ করে বাড়তি খাবার খাওয়াতে হবে। ১০ মাস থেকে ১ বছরের শিশুকে আধা বাটি করে তিন বেলা, মাঝে ১–২ বার নাশতা দেওয়া যেতে পারে। এক বছর পর এক বাটি করে তিন বেলা খাবারের সঙ্গে নাশতা দিন। ২ বছরের পর থেকে ঘরের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই নিয়মে খাবে।

২. খাবারের ঘনত্ব ঠিক রাখতে হবেঃ খাবার পুরোপুরি ব্লেন্ড করে বা তরল করে দেওয়া যাবে না। আধা শক্ত খাবার শিশু কিছুটা চিবিয়ে খাবে। এতে খাবারের স্বাদ বুঝবে। চিবিয়ে খাওয়া পরে দ্রুত কথা বলার ক্ষেত্রেও সাহায্য করবে।

৩. ঘরের পরিবেশ সুস্থ ও শিশুবান্ধব রাখুনঃ শিশুকে ধৈর্য ধরে যত্ন ও স্নেহ–মমতার সঙ্গে খাওয়ান। সম্ভব হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বসিয়ে খাবার দিন। একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে বিভিন্ন সুন্দর ও রংবেরঙের পাত্রে পরিবেশন করলে খাবারের প্রতি আগ্রহ বোধ করবে।

৪. খাবারের বৈচিত্র্য আনুনঃ প্রতিদিন একই উপাদান দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি না দিয়ে ভিন্নভাবে দিন। ডিমও প্রতিদিন সেদ্ধ না দিয়ে কখনো ভাজা বা পুডিং হিসেবে দিন।

৫. শিশুকেও খাবার আয়োজনে যুক্ত করুনঃ খাবার রান্না ও পরিবেশনের সময় শিশুকে সঙ্গে রাখুন। একটু বড় হলে আঙুল দিয়ে ধরে খেতে পারে, এ ধরনের খাবারগুলো নিজের হাতে খেতে উৎসাহ দিন।

যা করবেন না

১. বাচ্চাদের জোর করে, ভয় দেখিয়ে খাওয়াবেন না।

২. চকলেট, চিপস, জুস দেবেন না। এসব রুচি নষ্ট করে এবং সহজেই পেট ভরিয়ে ফেলে, তখন ঘরে তৈরি পুষ্টিকর খাবার খেতে চায় না।

৩. মোবাইল, টিভি ইত্যাদি যন্ত্রের সামনে বসিয়ে না খাওয়ানোই ভালো। এতে খাবারের প্রতি মনোযোগ না থাকায় কী খাচ্ছে, তা বুঝতে পারে না।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন

  • শিশু খাওয়াদাওয়া করছে না, সেই সঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়ছে, অপুষ্টির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
  • শিশু খেলাধুলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
  • শিশু খাবার খাচ্ছে না। অন্যান্য উপসর্গ যেমন গলাব্যথা, বমি, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যা হচ্ছে। এসব কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে না।
  • জিহ্বার ওপরে পুরু সাদা স্তর পড়ে গেছে, যা ছত্রাকের কারণে হতে পারে।

খাওয়া দাওয়া না করার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক বিকাশ, কথা বলা, অন্যান্য দিক ঠিক আছে কি না, সেটাও লক্ষ করতে হবে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ কোনো খাবারের গন্ধ, রং বা স্বাদের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকার কারণে কিছু খাবার খেতে চায় না। আবার সেরিব্রাল পলিসি, হাইপোথাইরয়েডিজম ইত্যাদি রোগের কারণে খেতে পারে না। সেই সঙ্গে হাঁটা, বসা ইত্যাদি সময়মতো হয় না। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Continue Reading

Latest Post

speech delay speech delay
স্মার্ট প্যারেন্টিং1 week ago

স্পিচ ডিলে বা শিশুর কথা বলার দেরির কারণ ও সমাধান

ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞএম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) প্রযুক্তির...

winter-baby-bathing-tips winter-baby-bathing-tips
নবজাতকের সেবা2 weeks ago

শীতকালে শিশুর গোসল: সতর্কতা ও সঠিক পদ্ধতি

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শীতকালে শিশুকে গোসল করানোর সময় অতিরিক্ত যত্ন ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। ঠান্ডা-কাশি...

impact-of-electronic-devices-on-children-and-teens impact-of-electronic-devices-on-children-and-teens
স্মার্ট প্যারেন্টিং3 weeks ago

শিশু এবং কিশোরদের উপর ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব

ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞএম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) সব...

baby winter care baby winter care
নবজাতকের সেবা1 month ago

শীতে শিশুর যত্ন

শীতের আগমন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে। তবে এই সময়টায় শিশুরা নানা ধরনের শারীরিক ও ত্বকের সমস্যার মুখোমুখি...

হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (HFMD) হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (HFMD)
অসুখ বিসুখ1 month ago

হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (HFMD)

ডাঃ মায়িশা হোসেন  MBBS Training/Course: PGT (Gynae & Obs) হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (Hand, Foot, and Mouth Disease) একটি...

child development child development
স্মার্ট প্যারেন্টিং2 months ago

নবজাতকের মানসিক, ইমোশনাল এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ: একটি অন্তর্দৃষ্টি

ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)...

cow milk cow milk
শিশু খাদ্য2 months ago

শিশুকে গরুর দুধ কখন থেকে খাওয়াবেন?

আগে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, বাচ্চাকে ২ বছরের আগে গরুর দুধ খাওয়ানো যাবে না এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও একই...

medicine and pregnancy medicine and pregnancy
গর্ভকালীন সেবা3 months ago

গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনে সচেতনতা

গর্ভাবস্থাজীবনের একটি বিশেষ সময়, যা প্রতিটি মায়ের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই সময় মায়ের স্বাস্থ্য সরাসরি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই...

feeding-problems feeding-problems
স্মার্ট প্যারেন্টিং3 months ago

শিশুরা খেতে না চাইলে কি করবেন

প্রায় প্রত্যেক মায়ের এই অভিযোগ আমার বাচ্চা কিছু খেতে চায় না। সারা দিন খাবার না দিলে না খেয়েই থাকে। আবার...

pretend play pretend play
স্মার্ট প্যারেন্টিং3 months ago

শিশুর সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রিটেন্ড প্লে বা অভিনয়-অভিনয় খেলা

আপনি কি কখনো দেখেছেন, আপনার বাচ্চা তার প্রিয় পুতুলটিকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে, আপনার জুতা পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে, বা একটি...

Trending