সব শিশুর দাঁত একই বয়সে ওঠে না। যদিও অধিকাংশ শিশুর প্রথম দাঁত ৬ মাস বয়সে উঠতে শুরু করে, তবে এর পূর্ব লক্ষণগুলো আরও আগে থেকেই দেখা দিতে পারে। অনেক সময় এই লক্ষণগুলো নিয়ে অভিভাবকদের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই লেখায় শিশুর দাঁত ওঠার প্রক্রিয়া, লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
টিথিং কখন শুরু হয়?
শিশুর দাঁত ওঠার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘টিথিং’ (Teething)। এটি সাধারণত ৪-৭ মাস বয়সে শুরু হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে ৩ মাসেই দাঁত ওঠে, আবার কিছু শিশুর ১২ মাস বা তার পরেও দাঁত উঠতে পারে—এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রতিটি শিশুর বৃদ্ধি ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় দাঁত ওঠার সময়েও ভিন্নতা থাকে।
টিথিং ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, কারণ শিশুর সব মিলিয়ে ২০টি দুধ দাঁত উঠতে সময় লাগে।
দাঁত ওঠার সাধারণ লক্ষণ
শিশুরা টিথিং চলাকালে বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে অস্বস্তি প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে কিছু লক্ষণ প্রায় সবার মধ্যে দেখা যায়:
১. অতিরিক্ত লালা ঝরা:
১০ সপ্তাহ থেকে ৪ মাস বয়সের মধ্যে শিশুদের মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা পড়তে শুরু করে। এতে জামা-কাপড় ভিজে গেলে বিব ব্যবহার করুন এবং থুতনি বারবার মুছে দিন যেন চামড়ায় র্যাশ না হয়।
২. মাড়িতে চেপে কিছু কামড়ানো:
মাড়িতে চাপ তৈরি হলে শিশুর অস্বস্তি বাড়ে। এই চাপ কমাতে তারা খেলনা, হাত, এমনকি বুকের দুধ খাওয়ার সময় স্তন কামড়াতে পারে। পরিষ্কার, ঠান্ডা কাপড় বা বিশেষ টিথার দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে।
৩. কান টানা ও গাল ঘষা:
মাড়ি, কান ও গলা সংযুক্ত থাকার কারণে শিশুরা দাঁতের ব্যথার সময় কান বা গাল ঘষতে পারে। তবে কানে টানার কারণ ইনফেকশনও হতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন।
৪. খাওয়ার অনীহা:
দাঁতের ব্যথার কারণে শিশুরা কখনও বুকের দুধ বা খাবার খেতে চায় না। পেট খালি থাকলে অস্বস্তি আরও বাড়ে, ফলে খিটখিটে মেজাজ দেখা দেয়।
৫. র্যাশ বা ঘা:
অতিরিক্ত লালার জন্য মুখ, গলা বা বুকে ফুসকুড়ি হতে পারে। ভ্যাসলিন বা হালকা, গন্ধহীন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন।
৬. কাশি বা গ্যাগ রিফ্লেক্স:
অতিরিক্ত লালা গলায় জমে কাশি হতে পারে। যদি অন্য কোনো উপসর্গ না থাকে তবে চিন্তার কিছু নেই।
৭. ঘ্যানঘ্যান ও কান্না:
কোমল মাড়িতে দাঁত ফোটার সময় প্রদাহ ও ব্যথার কারণে শিশুরা ঘন ঘন কান্না করে। প্রথম দাঁত এবং বড় মাড়ির দাঁত তুলনামূলক বেশি ব্যথাদায়ক।
৮. ঘুমের ব্যাঘাত:
দাঁত ওঠার সময় শিশুরা রাতে ঘুম থেকে বারবার জেগে উঠতে পারে।
৯. মাড়িতে হেমাটোমা:
নীলচে ফোলা দাগ দেখা দিলে তা দাঁত ওঠার কারণে রক্ত জমাট বেঁধে তৈরি হওয়া হেমাটোমা হতে পারে। সাধারণত এটি বিপজ্জনক নয়, তবে বাড়তে থাকলে শিশুদের দাঁতের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
দাঁত ওঠার সাধারণ ক্রম:
১. মধ্য কর্তন দাঁত (Central Incisors): সাধারণত নিচের সামনের দাঁত দুটি প্রথমে ওঠে।
২. পাশের কর্তন দাঁত (Lateral Incisors): এরপর পাশে দাঁত ওঠে।
৩. প্রথম মোলার: সামনের দাঁতের পরে পেছনের মোলার দাঁত ওঠে।
৪. ক্যানাইন (Canines): চোখের নিচের ধারালো দাঁত উঠতে শুরু করে।
৫. দ্বিতীয় মোলার: সবশেষে সবচেয়ে পেছনের দাঁতগুলো উঠতে পারে, সাধারণত ২-৩ বছর বয়সে।
টিথিং চলাকালে শিশুকে শান্ত করার উপায়:
১. টিথিং খেলনা ও ঠান্ডা বস্তু:
নিরাপদ রাবার টিথার বা ঠান্ডা, পরিষ্কার কাপড় চিবাতে দিন।
ফ্রিজে রাখা ওয়াশক্লথ বা টিথারও ব্যবহার করা যায় (ডিপ ফ্রিজ নয়)।
২. ঠান্ডা খাবার ও পানি:
৬ মাসের বেশি বয়স হলে ঠান্ডা পানি বা ঠান্ডা খাবার যেমন দই বা আপেল পিউরি দেওয়া যায়।
ফুড ফিডারে ঠান্ডা ফল দিতে পারেন। তবে চোকিং-এর ঝুঁকি এড়াতে সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখুন।
৩. মাড়িতে চাপ দেওয়া:
পরিষ্কার আঙুল বা ভেজা টুথব্রাশ দিয়ে মাড়ি হালকা ঘষতে পারেন।
৪. ব্যথা উপশমকারী ওষুধ:
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী ডোজ নিশ্চিত করুন।
যেসব প্রতিকার এড়িয়ে চলা উচিত
- বেনজোকেন বা লিডোকেন জাতীয় জেল: এই ধরনের জেল সাধারণত দাঁতের ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এটি শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। FDA (Food and Drug Administration) এর মতে, বেনজোকেন বা লিডোকেন শিশুর রক্তে অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এতে শিশুর ঠোঁট ও ত্বক নীলচে হয়ে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- হোমিওপ্যাথিক দাঁতের জেল: এতে ক্ষতিকর উপাদান যেমন বেলাডোনা (Belladonna) থাকতে পারে। বেলাডোনা একটি বিষাক্ত উদ্ভিদ, যা সঠিক মাত্রায় না থাকলে শিশুর জন্য মারাত্মক হতে পারে। অনেক হোমিওপ্যাথিক দাঁতের জেলে এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা খিঁচুনি, দুর্বলতা বা শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, এই জাতীয় পণ্যের কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
- অ্যাম্বার টিথিং নেকলেস: এই নেকলেস সাধারণত প্রাকৃতিক অ্যাম্বার পাথর দিয়ে তৈরি হয় এবং বলা হয় যে এটি দাঁতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু এটি কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া প্রচারিত একটি পদ্ধতি। শিশুর গলায় নেকলেস পরানো হলে এটি শ্বাসনালিতে আটকে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া, খেলতে গিয়ে এটি ছিঁড়ে গেলে ছোট পাথর গিলে ফেলার সম্ভাবনাও থাকে, যা গলায় আটকে যেতে পারে। তাই এই ধরনের পণ্য ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।
রাতে ঘুম ভেঙে গেলে করণীয়
- নিজে নিজে ঘুমাতে পারে কি না দেখে নিন।
- না পারলে পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিন।
- অতিরিক্ত অস্থির হলে ডাক্তার নির্দেশিত ব্যথানাশক ব্যবহার করুন।
- ইনফেকশন বা অন্য উপসর্গ আছে কি না লক্ষ্য করুন।
ডাক্তারের পরামর্শ কবে নেওয়া উচিত?
- উচ্চ জ্বর (১০১°F-এর বেশি)।
- দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া।
- মাড়ির রক্তপাত বা ফোলাভাব বেড়ে যাওয়া।
- কানের ইনফেকশনের লক্ষণ।
- অতিরিক্ত কান্না ও খাওয়ার অনীহা।
শিশুর দাঁত ওঠা একটি স্বাভাবিক এবং ধাপে ধাপে চলা প্রক্রিয়া। এটি প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা হতে পারে, তাই দাঁত ওঠার সময়ের ভিন্নতা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এই সময় শিশুর নানা ধরনের অস্বস্তি বা উপসর্গ দেখা দিলেও তা অস্থায়ী এবং সঠিক যত্ন ও ভালোবাসায় শিশু স্বস্তি পায়। শিশুর টিথিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে বাবা-মা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই সময়টা পার করতে পারেন।
প্রতিটি শিশু ভিন্ন, তাই তাদের বেড়ে ওঠার ধাপগুলোও আলাদা হতে পারে—এটাই স্বাভাবিক।