গর্ভকালীন সেবা
গর্ভের শিশুর ব্রীচ পজিশন

গর্ভে বেশিরভাগ শিশুই ডেলিভারির আগে মাথা নীচের দিকে এবং পা ওপরের দিকে দিয়ে রাখে। এই অবস্থানকে ডাক্তারি ভাষায় ‘সেফালিক’ প্রেজেন্টেশন বা পজিশন বলা হয়। এই অবস্থানে থাকলে নরমাল ডেলিভারি করা অনেকটা সহজ হয়।
ব্রিচ পজিশন (Breech Position) হল সেই অবস্থান যেখানে গর্ভাবস্থায় শিশুটি মায়ের গর্ভে মাথা নিচে না থেকে পা বা নিতম্ব নিচের দিকে থাকে। সাধারণত, শিশুর জন্মের সময় মাথা প্রথমে প্রসবের পথে বেরিয়ে আসে, কিন্তু ব্রিচ অবস্থানে শিশুর নিতম্ব বা পা প্রথমে বের হতে চায়। এমন হলে শিশুর ডেলিভারির জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে।
ব্রিচ পজিশন কি কমন?
গর্ভে ৩৯ সপ্তাহ পূর্ণ করে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের ‘ফুল টার্ম’ বলা হয়। এমন প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে প্রায় ৯৬-৯৭টি শিশুর মাথা নিচের দিকে থাকে, যা স্বাভাবিক অবস্থান এবং ৩–৪টি শিশুর ক্ষেত্রে ব্রিচ পজিশন দেখা যায়।
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে শিশুরা ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করে, তাই তখন ব্রিচ পজিশন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ৩৬-৩৭ সপ্তাহের পরেও যদি শিশুটি ব্রিচ পজিশনে থাকে, তাহলে চিকিৎসকরা প্রায়ই সিজারিয়ান সেকশন (সিজার) করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ব্রিচ পজিশনের কারণ
ব্রিচ পজিশনের নির্দিষ্ট কারণ সবসময় জানা যায় না, তবে কিছু ফ্যাক্টর বা কারণ রয়েছে যা ব্রিচ অবস্থানের ঝুঁকি বাড়াতে পারে-
- অতিরিক্ত বা কম অ্যামনিওটিক ফ্লুইড: গর্ভে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ খুব বেশি বা খুব কম হলে শিশুর অবস্থান স্থির হতে সমস্যা হতে পারে, যার ফলে ব্রিচ পজিশন হতে পারে।
- গর্ভাশয়ের আকার বা আকৃতি: মায়ের গর্ভাশয়ের আকার বা আকৃতি যদি অস্বাভাবিক হয় (যেমন, বাইকর্নুয়েট বা সেপটেট ইউটেরাস), তবে শিশুর ঘুরে সঠিক অবস্থানে আসা কঠিন হতে পারে।
- মাল্টিপল গর্ভধারণ: যমজ বা একাধিক শিশুর গর্ভাবস্থা থাকলে তাদের জন্য গর্ভে পর্যাপ্ত স্থান না থাকার কারণে একটি বা একাধিক শিশু ব্রিচ পজিশনে থাকতে পারে।
- প্রিভিয়াস ব্রিচ ডেলিভারি: পূর্বে ব্রিচ ডেলিভারি হয়ে থাকলে, পরবর্তী গর্ভাবস্থায় ব্রিচ অবস্থানের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
- প্রিম্যাচিউরিটি: গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের আগেই যদি শিশুর জন্ম হয়, তবে তার ব্রিচ পজিশনে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে, কারণ এই সময়ের মধ্যে শিশু সঠিকভাবে মাথা নিচের দিকে ঘুরে যেতে পারে না।
- অন্য কোনো শারীরিক কারণ: যেমন, প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া (প্ল্যাসেন্টা নিচে থাকা), বা শিশুর জন্মগত কিছু ত্রুটি থাকলেও ব্রিচ পজিশন হতে পারে।
এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না, এবং এটি কেবল একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন হতে পারে।
শিশু ব্রিচ পজিশনে আছে কি না বোঝার উপায়
গর্ভে শিশু কোন অবস্থানে আছে সেটা আপনার জন্য বোঝা কঠিন হতে পারে। তাই শিশু ডেলিভারির জন্য সঠিক অবস্থানে আছে কি না জানতে নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপে যাবেন। চেকআপের সময়ে ডাক্তার আপনার পেটে হাত রেখে পরীক্ষা করবেন। এভাবে শিশু ব্রিচ পজিশনে থাকলে তিনি সেটা বুঝতে পারবেন।
ডাক্তার মূলত আপনার পেটের বিভিন্ন জায়গায় আলতো চাপ দিয়ে গর্ভে শিশুর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করবেন। এভাবে তিনি আপনার পেটের ভেতর শিশুর মাথা, পিঠ, পা ও নিতম্বের অবস্থান খুঁজে বের করবেন। ব্রিচ পজিশনে থাকলে শিশুর মাথা ওপরের দিকে এবং নিতম্ব ও/অথবা পা নিচের দিকে থাকবে। শিশুর পিঠ আপনার শরীরের যেকোনো একপাশে ঘুরানো থাকবে। এর সাথে ডাক্তার পেলভিক (যোনিপথে হাত ঢুকিয়ে) পরীক্ষা করতে পারেন।
তবে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি ব্রিচ পজিশন নিশ্চিত করার জন্য। এতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে শিশুটি গর্ভে কী অবস্থায় রয়েছে।
শিশু ব্রিচ পজিশনে থাকলে করণীয়
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন (ECV) একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক গর্ভের বাইরে থেকে মায়ের পেটের উপর চাপ প্রয়োগ করে শিশুটিকে ঘুরিয়ে মাথা নিচের দিকে আনার চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রিটার্ম ডেলিভারি বা অকাল প্রসবের ঝুঁকি এড়াতে গর্ভকালীন ৩৭ সপ্তাহে বা তারপরে এই পদ্ধতি চেষ্টা করা হয়। যদিও এটি সফল হলে শিশুটি সঠিক অবস্থানে চলে আসে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি সফল নাও হতে পারে।
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন চেষ্টা করার আগে ডাক্তার পদ্ধতিটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ কি না সেটি বিবেচনা করবেন। সেই অনুযায়ী পদ্ধতিটির সুবিধা-অসুবিধা ও ঝুঁকি সম্পর্কে আপনার সাথে আলোচনা করে নিবেন।
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন পদ্ধতি
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন হল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে অভিজ্ঞ প্রসূতি চিকিৎসক মায়ের পেটের উপর থেকে হাতে চাপ প্রয়োগ করে শিশুটিকে ব্রিচ পজিশন থেকে ঘুরিয়ে মাথা নিচের দিকে আনতে চেষ্টা করেন। এই পদ্ধতিটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের পর প্রয়োগ করা হয়। পদ্ধতিটি প্রায় ৫০% ক্ষেত্রেই সফল হয়।
এটা একটা নিরাপদ প্রক্রিয়া, এতে পেট কাটার বা কোনো অপারেশন করার প্রয়োজন হয় না। তবে শিশুকে ঘোরানোর সময়ে কিছুটা অস্বস্তি লাগতে পারে।
পদ্ধতির উদ্দেশ্য:
- স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়ানো।
- সিজারিয়ান সেকশনের প্রয়োজনীয়তা কমানো।
এক্ষেত্রে একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে- এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন অবশ্যই হাসপাতালে বা অভিজ্ঞ গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে করাতে হবে। যেন মা অথবা শিশুর কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।এটা সচরাচর ডেলিভারি রুম বা অপারেশন থিয়েটারের কাছেই করানো হয়, যেন প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে সিজার করিয়ে মা ও শিশুকে সুস্থ রাখা যায়।

এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন পদ্ধতিটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
- এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন করার আগে আপনার শিশু আসলেই ব্রিচ পজিশনে আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে সাধারণত একটা আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করা হবে। এর পাশাপাশি আপনার হার্টবিট ও রক্তচাপ পরীক্ষা করে নেওয়া হবে। শিশুর হার্টবিটও দেখে নেওয়া হবে।
- সাধারণত পদ্ধতির শুরুতে আপনার জরায়ুকে হালকা রিল্যাক্স বা শিথিল করার জন্য একটা ইনজেকশন দেওয়া হবে, যা আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ। ইনজেকশনটা দেওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য আপনার হার্টবিট সামান্য বেড়ে যেতে পারে, রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে হালকা গরম লাগতে পারে। এগুলো সাময়িক, কিছুক্ষণ পরেই চলে যায়।
- এরপর ডাক্তার আপনার পেটে হাত রাখবেন। এসময়ে হাতের সাহায্যে আপনার পেটের ওপর হালকা চাপ দিয়ে গর্ভের ভেতরে শিশুর অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করা হবে। এক্ষেত্রে ২ জন মানুষ দরকার হতে পারে।
- এসময়ে আপনার অস্বস্তি হতে পারে, কখনো কখনো কিছুটা ব্যথা লাগতে পারে। তবে পদ্ধতিটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়। আপনার ব্যথা হতে থাকলে ডাক্তার প্রক্রিয়াটা থামিয়ে দিবেন।
- মনিটরিং এর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হবার আগে ও পরে শিশুর হার্টরেট চেক করা হবে৷ শিশুর হার্টরেটে যদি কোনো সমস্যা বা কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, তাহলে সাথে সাথে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে।
- পদ্ধতিটা শেষ হওয়ার পর সাধারণত আরেকবার আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখে নেওয়া হবে যে গর্ভের শিশু সঠিক পজিশনে এসেছে কি না।
- আপনার রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় (যেমন: এ নেগেটিভ বা A -ve, বি নেগেটিভ বা B -ve, ও নেগেটিভ বা O -ve কিংবা এবি নেগেটিভ বা AB -ve), তাহলে এক্সটারনাল সেফালিক ভারসন করার পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ‘অ্যান্টি ডি’ নামের একটি ইনজেকশন নেওয়ার এবং বিশেষ একটা রক্ত পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
সতর্কতা-
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসনের পর নিচের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন-
- যোনিপথে রক্তপাত হলে
- পেটে ব্যথা হলে
- পেটে টান, খিচ বা কনট্র্যাকশন অনুভব করলে
- গর্ভের শিশুর নড়াচড়া কমে গেছে মনে হলে
কখন এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসন করা যাবে না-
- গর্ভে একের অধিক শিশু থাকলে
- ব্রিচ ছাড়া অন্য কোনো কারণে সিজারের প্রয়োজন হলে
- সম্প্রতি মাসিকের রাস্তায় রক্তপাত হলে
- গর্ভের শিশুর CTG বা হার্টবিটের পরীক্ষায় অস্বাভাবিকতা থাকলে
- গর্ভের শিশুর কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা থাকলে
- আপনার প্রজননতন্ত্রের নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা থাকলে
- গর্ভফুলের অবস্থান অস্বাভাবিক হলে অথবা গর্ভফুল জরায়ুর প্রাচীর থেকে ছিঁড়ে আসলে (ডাক্তারি নাম প্লাসেন্টাল এবরাপশন)
- ইতোমধ্যে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে বা পানি ভেঙে গেলে
এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসনের জটিলতা
সাধারণত এক্সটার্নাল সেফালিক ভারসনে তেমন জটিলতা সৃষ্টি হয় না। তবে কিছু ক্ষেত্রে নিচের জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে-
- সত্যিকার প্রসব শুরু হওয়ার আগেই পানি ভাঙা
- ইমারজেন্সি সিজারের প্রয়োজন হওয়া
- শিশুর হার্টরেটে সাময়িক অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসা
- প্লাসেন্টাল এবরাপশন—শিশু প্রসব হওয়ার আগেই জরায়ু থেকে গর্ভফুল ছিঁড়ে আসা
- যোনিপথে রক্তপাত হওয়া
- অকাল প্রসব হওয়া
- গর্ভের শিশুর নাড়ি প্রসবের রাস্তায় বেরিয়ে আসা
- বিরল কিছু ক্ষেত্রে মৃতপ্রসব হওয়া
গর্ভকালীন সেবা
গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনে সচেতনতা
গর্ভাবস্থাজীবনের একটি বিশেষ সময়, যা প্রতিটি মায়ের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই সময় মায়ের স্বাস্থ্য সরাসরি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। এসময় মায়ের শরীরে পরিবর্তন আসে এবং এই পরিবর্তনগুলোর উপর ভিত্তি করে ঔষধ গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আসুন জেনে নিই কীভাবে গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবন সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং নিজে ও আপনার শিশুকে সুস্থ রাখবেন।

গর্ভাবস্থার পুরো সময় জুড়ে মায়ের শরীর নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, আর এই পরিবর্তনগুলো সরাসরি শিশুর স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। ঔষধের প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হতে পারে। গর্ভস্থ শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, মায়ের ঔষধ গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
ডাক্তারের পরামর্শ: ঔষধ গ্রহণের প্রথম শর্ত
প্রতিদিনের ছোটখাটো অসুস্থতার জন্য আমরা অনেক সময় নিজে থেকেই ঔষধ সেবন করি। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এ ধরনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়া ক্ষতিকর হতে পারে। সাধারণ সর্দি, কাশি, বা মাথাব্যথার মতো সমস্যার জন্যও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ, অনেক ঔষধ গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং, কোনও ধরনের চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ
গর্ভাবস্থায় কোন ঔষধ সেবন করার আগে সেটি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সঠিক ডোজ এবং নির্ধারিত সময় মেনে ঔষধ খাওয়া জরুরি। কারণ ডোজে কোন ধরনের পরিবর্তন হলে তা মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রাকৃতিক ও হারবাল ঔষধ সেবনে সতর্কতা
প্রাকৃতিক বা হারবাল ঔষধ অনেক সময় ক্ষতিকর হতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ হারবাল ঔষধকে নিরাপদ মনে করেন, কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটি মায়ের এবং শিশুর স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই যেকোনো প্রকার হারবাল ঔষধ সেবনের আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে ঔষধ গ্রহণের বিশেষ সতর্কতা
গর্ভাবস্থার সময়কে সাধারণত তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়—প্রথম তিন মাস (প্রথম ট্রাইমেস্টার), মধ্যের তিন মাস (দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার), এবং শেষের তিন মাস (তৃতীয় ট্রাইমেস্টার)। প্রতিটি ধাপে মায়ের ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
প্রথম তিন মাসের ঔষধ সেবন
প্রথম তিন মাস গর্ভস্থ শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠনের সময়। এই সময় যেকোনো প্রকার ঔষধ সেবন করলে শিশুর শারীরিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই প্রথম তিন মাসে যে কোনো ঔষধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা জরুরি।
মধ্যের তিন মাসের ঔষধ সেবন
মধ্যের তিন মাস তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, মায়ের শরীরের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুর বৃদ্ধি এসময় দ্রুত হয়। এই সময় কোন ঔষধ গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
শেষ তিন মাসের ঔষধ সেবন
শেষ তিন মাসেও সতর্কতার প্রয়োজন। যেকোনো প্রকার ঔষধ শিশুর জন্মের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া কিছু ঔষধ প্রিম্যাচিউর লেবার বা শিশুর প্রিম্যাচিউর জন্মের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কোন ঔষধগুলি গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিত
গর্ভাবস্থায় কিছু ঔষধ গ্রহণ করলে তা মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিচে উল্লেখিত ঔষধগুলো এড়িয়ে চলা উচিত:
১. অ্যাসপিরিন ও অন্যান্য ব্যথানাশকঃ অনেক ব্যথানাশক ঔষধ গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন প্রভৃতি ঔষধ গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
২. অ্যান্টিবায়োটিকঃ অনেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ গ্রহণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি।
৩. অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টঃ যেসব ঔষধ মনের অবস্থার উন্নতি করতে ব্যবহৃত হয়, সেগুলি গর্ভস্থ শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. এন্টিহিস্টামিন ও ডিকঞ্জেস্ট্যান্টঃ যেকোনো ধরনের অ্যালার্জি বা ঠান্ডা জনিত ঔষধ সেবন করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা জরুরি। কিছু এন্টিহিস্টামিন ঔষধ গর্ভস্থ শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ফার্মাসিস্টের পরামর্শে ঔষধ সেবন করবেন না
বেশিরভাগ মানুষ ঔষধ ক্রয়ের জন্য ফার্মেসির ওপর নির্ভরশীল। তবে ফার্মাসিস্ট বা ফার্মেসির কর্মীরা সাধারণত চিকিৎসক নন এবং তারা মায়ের নির্দিষ্ট শারীরিক অবস্থা, রোগের ইতিহাস বা অন্যান্য বিবরণ সম্পর্কে জানেন না। এতে ভুল ঔষধ সেবন বা ডোজের ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা মা এবং শিশুর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত ঔষধ গ্রহণ করা উচিত নয়।
গর্ভাবস্থায় নিরাপদ কিছু ঔষধ
গর্ভাবস্থায় সব ঔষধ ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কিছু সাধারণ সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদ ঔষধ রয়েছে, তবে সেগুলি গ্রহণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ:
প্যারাসিটামল: মাথাব্যথা বা জ্বরের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল নিরাপদ বলে ধরা হয়।
এন্টাসিড: গ্যাস্ট্রিক বা বুকজ্বালা কমাতে কিছু এন্টাসিড গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভিটামিন ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট: গর্ভাবস্থায় শরীরে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষ কিছু ভিটামিন এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার কিছু সাধারণ পরামর্শ
গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনের পাশাপাশি নিজের শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। সুস্থ থাকতে কিছু সহজ পদক্ষেপ অনুসরণ করা যেতে পারে:
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন এবং পুষ্টিকর খাবার খান।
হালকা ব্যায়াম: হালকা শরীরচর্চা করতে পারেন, তবে তা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন: নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন এবং কোনো মানসিক চাপ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
মায়ের স্বাস্থ্য যত ভালো থাকবে, গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যও তত ভালো থাকবে। গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে সচেতন থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে হলে মাকে অবশ্যই নিজে সচেতন হতে হবে, নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে এবং ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন এবং আপনার শিশুকে একটি স্বাস্থ্যকর জীবন উপহার দিন!
গর্ভকালীন সেবা
গর্ভাবস্থায় আয়রন
গর্ভাবস্থায় আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান । গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশ ও সুস্থ প্রসবের জন্য গর্ভবতীর আয়রনের চাহিদা মেটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আয়রন গর্ভাবস্থার সময় হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পরিবহনে সহায়ক। গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাব হলে অ্যানিমিয়া হতে পারে, যা মায়ের ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট এর উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। এই চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে তা আপনার ও গর্ভের শিশুর দেহে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে—
- গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া)। অ্যানিমিয়া একটি সাধারণ সমস্যা যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হলে যে-সব লক্ষণ দেখা দেয়—
- ক্লান্ত অনুভব করা
- শরীরের শক্তি কমে যাওয়া অথবা দুর্বল লাগা
- শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা
- বুক ধড়ফড় করা
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা থেকে ‘পিকা’ নামের একটি সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা হলে খুবই অদ্ভুত জিনিস, অর্থাৎ খাবার নয় এমন কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয়। যেমন: মাটি, কাগজ কিংবা দেয়ালের রং। এমন বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- এ ছাড়াও গর্ভকালীন আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবে গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে আপনার শিশু জন্মের সময়ে এবং জন্মের পরেও বেশ কিছু সমস্যায় ভুগতে পারে। যেমন—
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই, অর্থাৎ প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেওয়া
- জন্মের সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন হওয়া
- শিশুর স্বাভাবিক ব্যবহারগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া
- শিশুর শরীরে আয়রনের মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে কম হওয়া
গর্ভাবস্থায় আয়রনযুক্ত খাবার খাওয়ার পাশাপাশি বাড়তি আয়রনের চাহিদা মেটাতে নিয়মমতো আয়রন ট্যাবলেট সেবন করলে তা মা ও গর্ভের শিশুকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় কতটুকু আয়রন ট্যাবলেট খাবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মতে, গর্ভাবস্থায় আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। তবে এটি নির্ভর করে মায়ের শারীরিক অবস্থা এবং রক্তশূন্যতার মাত্রার ওপর। ডাক্তার নির্দিষ্ট পরীক্ষার ভিত্তিতে সঠিক ডোজ নির্ধারণ করবেন।
বাংলাদেশে গর্ভকালীন সময়ের জন্য আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। এতে গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক পরিমাণে আয়রন যোগ করা থাকে। সেই সাথে ফলিক অ্যাসিড থাকে, যা শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে এবং নানান জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে।
উল্লেখ্য, আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার মতো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে ৬০ মিলিগ্রামের বেশি ডোজে আয়রন সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন
গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট কখন ও কীভাবে খাবেন ?
গর্ভাবস্থার শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। সন্তান জন্মদানের তিন মাস পর পর্যন্ত আয়রন সেবন চালিয়ে যেতে হবে।
আয়রন ট্যাবলেট খাবার নিয়ম
আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খালি পেটে খেলে এটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে। তাই খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা খাবার শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা পরে এক গ্লাস পানির সঙ্গে এই ট্যাবলেট গ্রহণ করা উচিত। পানির পরিবর্তে এক গ্লাস কমলার রস বা লেবুর শরবতও ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ এতে থাকা ভিটামিন সি শরীরকে আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
তবে, খালি পেটে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খেলে অনেকের ক্ষেত্রে পেটে অস্বস্তি হতে পারে। যদি এমন হয়, তাহলে ডাক্তার আপনাকে খাবারের সাথে বা খাওয়ার পরপরই ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
সতর্কতা
আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের সাথে একই সময়ে অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাবেন না। এতে আয়রনের কার্যকারিতা কমে যায়। অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে আয়রন ট্যাবলেট খাবেন।
এ ছাড়াও কিছু কিছু খাবার শরীরে আয়রন শোষণের হার কমিয়ে ফেলতে পারে। আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার সময়ে এসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এমন কিছু খাবার হলো—
- চা ও কফি
- ডিম
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- সয়াবিনযুক্ত খাবার
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ক্ষেত্রে যে চারটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে —
- আপনি আগে থেকেই শুধুমাত্র আয়রন অথবা কোনো মাল্টিভিটামিন সেবন করে থাকলে, তা ডাক্তারকে জানাবেন৷ ডাক্তারের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়া কয়েক ধরনের মাল্টিভিটামিন, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে সেবন করা থেকে বিরত থাকবেন।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন সময়ে যে-সব মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়, সেসবে আয়রন যোগ করা থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় ডাক্তার আপনাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকলে আলাদা করে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন নেই।
- গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। এই ট্যাবলেট গর্ভাবস্থায় একই সাথে আয়রন ও ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ করে। তাই এটি সেবন করলে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন (যেমন: আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা) ছাড়া আলাদা করে শুধু আয়রন ট্যাবলেট অথবা সিরাপ সেবনের প্রয়োজন নেই।
- নিয়মিত ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট সেবনের পরেও আপনার রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করাবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।
- গর্ভাবস্থায় আপনি অন্য যেকোনো ঔষধ সেবন করলে ডাক্তারকে সেই ঔষধের নাম ও ডোজটি জানান। অনেকসময় আয়রনের সাথে অন্যান্য ঔষধের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডোজ কমানো কিংবা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আয়রন ট্যাবলেট এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে হতে পারে। যেমন—
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- পাতলা পায়খানা
- পেট ব্যথা
- অ্যাসিডিটি, বুক জ্বালাপোড়া করা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
- বমি বমি ভাব ও বমি
- কালচে পায়খানা
- ড্রপের ক্ষেত্রে দাঁত কালচে হয়ে যাওয়া
যদিও খালি পেটে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া ভালো, তবুও পেট ব্যথা কিংবা পাতলা পায়খানার সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য খাবারের সাথে অথবা খাওয়ার ঠিক পর পরই আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাবেন। এতে করে আয়রন ট্যাবলেটজনিত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কিছুটা কমতে পারে।
তবে আপনার এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাওয়া বন্ধ করবেন না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও এই ঔষধ সেবন চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। আপনার যদি খুব বেশি সমস্যা বা অস্বস্তি হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। ডাক্তার আপনাকে অন্য ব্র্যান্ডের ঔষধ কিংবা ট্যাবলেটের বদলে ইনজেকশন হিসেবে আয়রন গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারে। তবে নিজে নিজে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বদল করে ফেলবেন না। এ ছাড়াও যদি আপনার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দেয় তাহলে ঔষধ সেবন বন্ধ করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনাকে নিয়মিত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়ে সাধারণত গর্ভাবস্থায় আয়রনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হলো—
- মাংস, বিশেষত গরু ও খাসির মাংসের মতো ‘রেড মিট’
- বিভিন্ন ডাল। যেমন: ছোলা, মাষকলাই, মুগ ও মসুর
- চিনাবাদাম, কাজুবাদাম ও পেস্তাবাদাম
- মটর ও মটরশুঁটি
- শুকনো ফল। যেমন: খেজুর, নারিকেল (শুকনা) ও আখরোট
- বিভিন্ন মাছ। যেমন: চাপিলা, ট্যাংরা, কাচকি, মলা, টাটকিনি, শিং, ফেসা ও চেলা
- ডিম
- দুধ ও পনির
- বিভিন্ন শাক। যেমন: পাট শাক, লাল শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, নটে শাক, সবুজ কচু শাক, চুকাই শাক, বরবটি পাতা, মালঞ্চ শাক, বকফুল শাক, মূলা শাক, লাউ শাক, পালং শাক ও পুঁই শাক
- বিভিন্ন সবজি। যেমন: আলু, ব্রকলি ও মাশরুম
- বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: যব, কাউন, ভুট্টা, চিড়া, গম, চালের কুড়া ও ঢেঁকিছাঁটা চাল
- বিভিন্ন বীজ। যেমন: সয়াবিন, তিল, সরিষা, তিসি, মিষ্টিকুমড়া বীজ, সূর্যমুখী বীজ, পদ্ম (শুকনা) ও চিলগোজা
আয়রনযুক্ত ঔষধ শিশুদের হাতের নাগালের বাইরে রাখুন। অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রন সেবনে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
গর্ভকালীন সেবা
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট ব্যবহারের নিয়ম
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট হলো একটি সহজ এবং সুবিধাজনক উপায় যা মহিলাদের গর্ভধারণের বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এটি মূলত প্রস্রাবের মাধ্যমে HCG (Human Chorionic Gonadotropin) হরমোন সনাক্ত করে, যা গর্ভধারণের সময় শরীরে উৎপন্ন হয়। এই আর্টিকেলে আমরা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট ব্যবহারের সঠিক নিয়ম নিয়ে আলোচনা করব।
প্রস্তুতকারকভেদে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের ব্যবহারবিধি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কিটের প্যাকেটের ভেতরের নির্দেশিকায় কীভাবে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে হবে সেটি বিস্তারিতভাবে লেখা থাকে। নির্দেশিকা অনুসরণ করে আপনি সহজেই ঘরে বসে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে ফেলতে পারবেন।
সচরাচর যেসব প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট পাওয়া যায়, সেগুলোর প্যাকেটের ভেতরে একটি লম্বা কাঠি বা বক্স থাকে। তাতে একটি ‘S’ লেখা ঘর থাকে। এ ঘরে আপনাকে কয়েক ফোঁটা প্রস্রাব দিয়ে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর বক্সের ‘C’ ও ‘T’ লেখা অন্য দুইটি ঘরের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
শুধু ‘C’ ঘরে একটি দাগ দেখা গেলে পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ, অর্থাৎ আপনি হয়তো গর্ভবতী না। আর ‘C’ ও ‘T’ দুইটি ঘরেই দাগ দেখা গেলে ফলাফল পজিটিভ, অর্থাৎ আপনি গর্ভবতী।

প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কীভাবে কাজ করে?
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের মাধ্যমে প্রস্রাবে ‘বেটা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন’ নামের একটি বিশেষ হরমোনের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। গর্ভবতী নারীদের প্রস্রাবে এই হরমোনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। যা কিটের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
টেস্ট কিট দিয়ে প্রস্রাবে এই হরমোনের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেলে সেই ফলাফলকে ‘পজিটিভ’ বলে। আর শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ হরমোন না পাওয়া গেলে তাকে ‘নেগেটিভ’ বলে। ফলাফল পজিটিভ আসলে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হয়ে থাকে। তাই ফলাফল পজিটিভ আসলে একজন গাইনী ডাক্তার অথবা হাসপাতালে গিয়ে গর্ভাবস্থায় করণীয় সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের ফলাফল কি নির্ভরযোগ্য?
সাধারণত সঠিক নিয়মে পরীক্ষা করলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য দেয়।তবে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের ফলাফল হিসাবের সময়ে নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি—
গর্ভধারণের ছয় দিন পর থেকেই শরীরে ‘বেটা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন’ নামের বিশেষ হরমোন তৈরি হতে শুরু করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আট-দশ দিন সময়ও লাগতে পারে। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে। ধীরে ধীরে এই হরমোনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তাই অনেকক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থার একেবারে শুরুর দিকে কিট দিয়ে পরীক্ষা করলে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে।
অনেকেই অনিয়মিত মাসিকের সমস্যায় ভোগেন। ফলে তারা মাসিকের সম্ভাব্য তারিখ ঠিকমতো হিসাব করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণ হরমোন তৈরি হওয়ার আগেই টেস্ট করে ফেলতে পারেন। এমন হলেও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে।
এ ছাড়াও প্যাকেটের নির্দেশনা ঠিকমতো না মেনে পরীক্ষা করলে গর্ভবতী হলেও ভুলবশত কিট টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে।
তাই টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসার পরেও আপনার পিরিয়ড না হলে অথবা আপনার নিজেকে গর্ভবতী মনে হলে কয়েকদিন পর আবার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে পারেন।
দ্বিতীয়বার টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসার পরেও যদি আপনার পিরিয়ড না হয় তাহলে দ্রুত কোনো গাইনী ডাক্তার অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা সদর হাসপাতালে যেতে হবে। সেখানে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আপনি গর্ভবতী কি না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন।
Latest Post


শিশুর এডিনয়েড সমস্যা
শীতকালে সাধারণত শিশু ও কিশোরদের ঠান্ডা-সর্দি জনিত নানা রোগ বাড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে নাক, গলা ও কানের সমস্যা বেড়ে...


নবজাতকের চর্মরোগ হলে বাবা-মায়ের করণীয়: সহজ সমাধান ও পরামর্শ
নবজাতকের জন্মের পরপরই চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। নবজাতকের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে থাকে। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ত্বক খুব সহজেই...


স্পিচ ডিলে বা শিশুর কথা বলার দেরির কারণ ও সমাধান
ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞএম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) প্রযুক্তির...


শীতকালে শিশুর গোসল: সতর্কতা ও সঠিক পদ্ধতি
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শীতকালে শিশুকে গোসল করানোর সময় অতিরিক্ত যত্ন ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। ঠান্ডা-কাশি...


শিশু এবং কিশোরদের উপর ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব
ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞএম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) সব...


শীতে শিশুর যত্ন
শীতের আগমন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে। তবে এই সময়টায় শিশুরা নানা ধরনের শারীরিক ও ত্বকের সমস্যার মুখোমুখি...


হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (HFMD)
ডাঃ মায়িশা হোসেন MBBS Training/Course: PGT (Gynae & Obs) হ্যান্ড, ফুট এন্ড মাউথ ডিজিস (Hand, Foot, and Mouth Disease) একটি...


নবজাতকের মানসিক, ইমোশনাল এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ: একটি অন্তর্দৃষ্টি
ডা: মৌমিতা পাল শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এম.বি.বি.এস (এস.ইউ. এস.টি )এমডি, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)...


শিশুকে গরুর দুধ কখন থেকে খাওয়াবেন?
আগে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, বাচ্চাকে ২ বছরের আগে গরুর দুধ খাওয়ানো যাবে না এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও একই...


গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনে সচেতনতা
গর্ভাবস্থাজীবনের একটি বিশেষ সময়, যা প্রতিটি মায়ের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই সময় মায়ের স্বাস্থ্য সরাসরি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই...
Trending
-
গর্ভকালীন সেবা8 months ago
গর্ভাবস্থার সময়কাল গণনা করার নিয়ম
-
গর্ভকালীন সেবা6 months ago
গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনে সচেতনতা
-
গর্ভকালীন সেবা7 months ago
গর্ভাবস্থায় আয়রন
-
অসুখ বিসুখ8 months ago
এমপক্স (মাঙ্কিপক্স)
-
গর্ভকালীন সেবা10 months ago
গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের গুরুত্ব
-
স্মার্ট প্যারেন্টিং8 months ago
শিশুর সামনে যে বিষয়ে আলোচনা করবেন না
-
গর্ভকালীন সেবা8 months ago
প্রেগন্যান্সির লক্ষণ
-
গর্ভকালীন সেবা7 months ago
প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট ব্যবহারের নিয়ম
মেহেরুন্নেছা
October 20, 2024 at 2:49 am
আমার বাচ্চা ডান দিকে বেশি নরাচরা করে