ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায় এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে আক্রান্ত করে। অনেক সময় এই রোগটি সাধারণ জ্বর হিসেবেই শুরু হয় এবং বাসায় চিকিৎসায় সেরে ওঠা সম্ভব হয়। তবে কখনো কখনো এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করে প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ শনাক্ত, সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই লেখায় ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, জটিলতা, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ডেঙ্গুর লক্ষণ: কখন সতর্ক হবেন? ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। আবার অনেক সময় সাধারণ সর্দিজ্বর ভেবে উপসর্গগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, যার ফলে রোগটি জটিল আকার নিতে পারে। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। কখন লক্ষণ দেখা দিতে পারে? ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর সাধারণত ৩–১৪ দিনের মধ্যে (গড়ে ৪–৭ দিন) লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ সময় হঠাৎ করেই উচ্চ জ্বর (১০৪°F পর্যন্ত) দেখা দিতে পারে, সঙ্গে কাঁপুনি ও শরীরব্যাপী অস্বস্তি শুরু হয়। ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণসমূহ নিম্নে ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো তুলে ধরা হলো— তীব্র জ্বর (৪০°C বা ১০৪°F পর্যন্ত)। মাথাব্যথা, বিশেষ করে কপালের দিকে। চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব। পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (এ কারণে ডেঙ্গুকে ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ বলা হয়)। বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া। শরীরের গ্রন্থি ফোলা (বগল, কুঁচকি বা গলা)। ত্বকে লালচে র্যাশ বা ফুসকুড়ি। খাবারে অরুচি ও পেট ব্যথা। সাধারণত এই উপসর্গগুলো ২–৭ দিন স্থায়ী হয় এবং বেশিরভাগ মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেন। শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অনেক সময় ভিন্নরকম হয়। কিছু লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো— শরীরে শক্তি কমে যাওয়া বা দুর্বলতা। ঘুম ঘুম ভাব ও খিটখিটে মেজাজ। বারবার কান্না বা চিৎকার করা। লালচে র্যাশ। নাক, মাড়ি বা ত্বকের নিচে রক্তপাত। দিনে ৩ বার বা তার বেশি বমি হওয়া। ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ (মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া)। এক বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের ডেঙ্গু দ্রুত মারাত্মক আকার নিতে পারে। তাই উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসা নিন। ⚠ মারাত্মক ডেঙ্গুর লক্ষণ ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতি ২০ জনে ১ জনের ক্ষেত্রে রোগটি ‘সিভিয়ার ডেঙ্গু’ বা মারাত্মক ডেঙ্গুতে রূপ নিতে পারে। এই অবস্থায় নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে— তীব্র পেটব্যথা বা পেট ফুলে যাওয়া। দিনে ৩ বার বা তার বেশি বমি। রক্তপাত (নাক, মাড়ি, পায়খানা বা প্রস্রাবে রক্ত)। রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। ত্বকে লাল দাগ বা রক্তপাতের ছোপ। শরীর ঠাণ্ডা, ঘেমে যাওয়া ও ফ্যাকাশে রঙ। দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস ও দুর্বল পালস (নাড়ির গতি)। ঝিমুনি, অজ্ঞান হওয়া বা খিঁচুনি। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। চোখ বসে যাওয়া ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া। এই অবস্থায় দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো জরুরি। জ্বর কমলেও উপসর্গ অব্যাহত থাকলে বাড়িতে বসে না থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারা? ছোটো শিশু (বিশেষ করে এক বছরের নিচে)। গর্ভবতী নারী। যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে সিভিয়ার ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন। কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন? ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা সাধারণত সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে পুরোপুরি সেরে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না এবং বাসায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিতে পারে, যেখানে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর সিদ্ধান্ত। যাদের ক্ষেত্রে দ্রুত হাসপাতালে শরণাপন্ন হতে হবে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন, এমনকি মারাত্মক কোনো উপসর্গ প্রকাশ না পেলেও— গর্ভবতী নারী: গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ মায়ের পাশাপাশি অনাগত শিশুর জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এক বছর বা তার কম বয়সী শিশু: শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হওয়ায় দ্রুত অবনতি হতে পারে। বৃদ্ধ বা বয়স্ক ব্যক্তি: বয়সজনিত কারণে ডেঙ্গুর জটিলতা তাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: স্থূলতা ডেঙ্গুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জটিল করে তুলতে পারে। ক্রনিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি: যেমন—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইলিউর বা কিডনি সমস্যা। রক্তের সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তি: যারা দীর্ঘদিন ধরে রক্তস্বল্পতা বা অন্যান্য রক্তজনিত রোগে ভুগছেন। এছাড়াও আপনি যদি একাকী বসবাস করেন বা বাসায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন মনে হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই উত্তম। এতে করে আপনাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে এবং হঠাৎ কোনো জটিলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হবে। কখন ডেঙ্গু জটিল হতে পারে? ডেঙ্গু জ্বর সেরে যাওয়ার সময়ই সাধারণত মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়, যেমন— হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া। রক্তক্ষরণ। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করা। এই সময় রোগীর লক্ষণগুলো খুব সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, পেট ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট বা রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা গেলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য কোন কোন টেস্ট করানো প্রয়োজন? ডেঙ্গু জ্বর সন্দেহ হলে রোগ নির্ণয়ের জন্য দ্রুত ও সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সময়ে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারলে জটিলতা কমে এবং চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করা যায়। এই আর্টিকেলে আমরা জানব ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রচলিত পরীক্ষাগুলোর বিস্তারিত। ✅ ১. এনএস১ অ্যান্টিজেন (NS1 Antigen) পরীক্ষা এটি একটি দ্রুত রক্ত পরীক্ষা যা সাধারণত জ্বরের প্রথম দিন থেকেই ডেঙ্গু শনাক্তে কার্যকর। এই পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে। কার্যকারিতা: জ্বর আসার ১ম থেকে ৪র্থ দিন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। সীমাবদ্ধতা: ৪–৫ দিন পর থেকে পরীক্ষাটি নেগেটিভ আসতে পারে, এমনকি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও। মূল্য: বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই টেস্টের নির্ধারিত মূল্য প্রায় ৫০০ টাকা। ✅ ২. ডেঙ্গু IgM ও IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা এই টেস্ট দুটি রক্তের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করে। 🔸 IgM অ্যান্টিবডি টেস্ট: শুরু করা যায়: জ্বরের ৫ দিন পর থেকে। সবচেয়ে ভালো ফলাফল: জ্বরের ৭ দিন পর। উদ্দেশ্য: সাম্প্রতিক সংক্রমণ শনাক্ত করা। 🔸 IgG অ্যান্টিবডি টেস্ট: উদ্দেশ্য: আগে কখনো ডেঙ্গু হয়েছিল কি না তা বোঝা যায়। মূল্য: ৩০০–৫০০ টাকার মধ্যে। ✅ ৩. সিবিসি (CBC) পরীক্ষা CBC (Complete Blood Count) পরীক্ষা ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষায় যা দেখা হয়: রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিটের মাত্রা। ডেঙ্গু হলে: প্লাটিলেট কমে যেতে পারে, হেমাটোক্রিট বেড়ে যেতে পারে—যা রক্তে তরলের ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। মূল্য: ১৫০–৪০০ টাকার মধ্যে। অতিরিক্ত পরীক্ষা (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী) রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ডাক্তার নিচের অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন: ALT/SGPT ও AST/SGOT: যকৃতের কার্যকারিতা মূল্যায়নে। Urine Test (প্রস্রাব পরীক্ষা): শরীরে ডেঙ্গুর প্রভাব জানতে। ডেঙ্গুর ঘরোয়া চিকিৎসা: উপসর্গ উপশমে কার্যকর কিছু পরামর্শ ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার এখনো নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা