গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগা কি স্বাভাবিক? জানুন এর কারণ, প্রতিকার
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগা অনেক মায়েরই একটি সাধারণ অভিযোগ। শরীরের হরমোন পরিবর্তন, বাড়তি রক্তপ্রবাহ ও মেটাবলিজম বৃদ্ধির কারণে এই অস্বস্তি আরও বেড়ে যেতে পারে, বিশেষ করে আমাদের দেশের তাপপ্রবণ আবহাওয়ায়। অতিরিক্ত গরমে যেমন পানিশূন্যতা ও হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে, তেমনি তা গর্ভের শিশুর ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। এই লেখায় গরমে গর্ভবতী মায়েদের যে-সব সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং কীভাবে নিরাপদ ও স্বস্তিতে থাকা যায়, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগার কারণ গর্ভাবস্থা নারীর জীবনে এক অসাধারণ কিন্তু শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং সময়। এই সময় অনেক নারীকেই অতিরিক্ত গরম লাগা বা “হট ফ্ল্যাশ”-এর মতো অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয়। এটা স্বাভাবিক হলেও অনেক সময় অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। চলুন জেনে নিই, কেন এমনটা হয়। ১. পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) আমাদের শরীর গরম অনুভব করলে ঘাম উৎপন্ন করে তা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীরে যখন পানির ঘাটতি থাকে, তখন ঘামের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে শরীরের অতিরিক্ত তাপ বের হতে পারে না এবং আমরা অস্বাভাবিকভাবে গরম অনুভব করি। গর্ভাবস্থায় ডিহাইড্রেশন হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি থাকে, তাই পর্যাপ্ত পানি পান না করলে এই গরম অনুভূতি আরও তীব্র হতে পারে। ২. মেটাবলিজম বৃদ্ধি গর্ভাবস্থায় আপনি শুধু নিজের জন্য নয়, গর্ভের শিশুর জন্যও পুষ্টি জোগান দেন। ফলে আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি কাজ করে। এই বাড়তি কাজের ফলে মেটাবলিজম বা হজমক্রিয়ার গতি বেড়ে যায়। মেটাবলিক হার যত বেশি হবে, শরীর তত বেশি তাপ উৎপন্ন করবে — আর এটাই অতিরিক্ত গরম লাগার অন্যতম কারণ। ৩. হরমোনের তারতম্য গর্ভাবস্থায় শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে। এর ফলে আপনার মস্তিষ্কে থাকা থার্মোস্ট্যাট (Hypothalamus) সহজেই গরম অনুভব করতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে অতিরিক্ত ঘাম বা হট ফ্ল্যাশ হতে পারে। ৪. রক্ত চলাচলের বৃদ্ধি গর্ভস্থ শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায় রক্তসঞ্চালন বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত রক্তপ্রবাহ ত্বকের আশেপাশে তাপমাত্রা বাড়ায় এবং আপনাকে আরও গরম লাগতে পারে। করণীয় পর্যাপ্ত পানি পান করুন। হালকা, ঢিলেঢালা ও সুতির পোশাক পরুন। অতিরিক্ত গরম পরিবেশ এড়িয়ে চলুন। ঘর ঠান্ডা রাখতে ফ্যান বা এসি ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যাদের সমস্যা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে গর্ভাবস্থায় শরীরের হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনেক মায়েরই স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি গরম লাগতে পারে। তবে কিছু মায়ের জন্য এই অতিরিক্ত গরম সহ্য করা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ কিছু কারণের জন্য। নিচে আমরা এমন কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরেছি, যেখানে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরমে ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে: ১. যদি আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদি বা জটিল অসুখ থাকে যে-সব মায়ের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, কিডনির সমস্যা কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের জটিলতা আগে থেকেই থাকে—তাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গরমে দেহের স্বাভাবিক ভারসাম্য আরও বিঘ্নিত হতে পারে। এতে করে ক্লান্তি, মাথা ঘোরা বা পানিশূন্যতার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ২. যাঁরা নিয়মিত বাইরে কাজ করেন যে-সব গর্ভবতী নারী কর্মজীবী এবং নিয়মিত বাইরে যান, যেমন—স্কুলশিক্ষিকা, সেবিকা, নির্মাণশ্রমিক বা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন—তাদের সূর্যের প্রখর তাপ, ধুলাবালি ও আর্দ্রতার কারণে অতিরিক্ত গরমে ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ৩. যদি আপনি বাড়ির সবচেয়ে উপরের তলায় থাকেন বিল্ডিংয়ের উপরের তলাগুলো গরমের সময় সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়। রোদ সরাসরি ছাদে পড়ে বলে দিনের অনেকটা সময় ধরে ঘর গরম থাকে। এমন পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হতে পারে, যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম থেকে কী কী জটিলতা হতে পারে? গর্ভাবস্থায় শরীরের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে। এর ওপর যদি বাইরের পরিবেশে অতিরিক্ত গরম থাকে এবং শরীরের তাপমাত্রা ৩৯°C (১০২.২°F) এর বেশি উঠে যায়, তাহলে তা মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক হতে পারে। জেনে নিন অতিরিক্ত গরম থেকে কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়। ১. হিট ক্র্যাম্প হিট ক্র্যাম্প হচ্ছে এক ধরনের পেশির খিঁচুনি যা সাধারণত শরীরচর্চা বা গরমে অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীর থেকে লবণ ও পানি বেরিয়ে যাওয়ার কারণে হয়। হাত, পা ও পেটে ব্যথা অনুভব হতে পারে। করণীয় ব্যায়াম বা কাজ বন্ধ করে ঠান্ডা জায়গায় যান। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। ব্যথা না কমা পর্যন্ত বিশ্রাম নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন যদি: এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ক্র্যাম্প থাকে। খাদ্যে সোডিয়াম লবণের ঘাটতি থাকে। হৃদ্রোগ থাকে। ২. ডিহাইড্রেশন গরমে শরীর থেকে ঘাম ও বাষ্পের মাধ্যমে পানি বেরিয়ে গেলে, কিন্তু আপনি পর্যাপ্ত পানি না খেলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এটি প্লাসেন্টার রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে এবং ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন শুরু হতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে আপনি দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘুরিয়ে পড়েও যেতে পারেন। লক্ষণ: অতিরিক্ত তৃষ্ণা। গাঢ় ও গন্ধযুক্ত প্রস্রাব। মাথা ঘোরা, ক্লান্তি। ক্লান্তি বোধ। দ্রুত হার্টবিট। শুকনো ঠোঁট ও মুখ। চোখ কোটরে ঢুকে যাওয়া। দিনে ৪ বার বা কম প্রস্রাব হওয়া। ৩. হাত-পা ফুলে যাওয়া (ইডেমা) গরমে পানিশূন্যতার ফলে শরীর পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে। এই অতিরিক্ত পানি শরীরের নিচের দিকের অংশগুলোতে জমা হয়। বিশেষ করে যখন আপনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে করে নিচের অংশ যেমন হাত, পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতায় ফোলা দেখা দিতে পারে। প্রতিকার: একটানা দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিরত থাকুন। আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করুন। প্রচুর পানি পান করুন। হালকা ব্যায়াম করুন: পা বাঁকিয়ে-সোজা করে ৩০ বার উঠানামা। প্রতিটি পা ৮ বার করে ঘোরান। ৪. হিটর্যাশ বা ঘামাচি গর্ভাবস্থায় গরম থেকে আপনার ছোট ছোট লাল ফুসকুড়ি বা ঘামাচি সাধারণত কাঁধ, বগল, বুক, কুঁচকিতে হয়ে থাকে। করণীয়: ঠান্ডা ও শুকনো পরিবেশে থাকুন। ঘামাচি শুকিয়ে রাখুন। প্রয়োজনে বেবি পাউডার ব্যবহার করুন। ৫. মেলাসমা এটি গর্ভাবস্থায় গরম ও হরমোনের প্রভাবে মুখে বাদামি বা ধূসর দাগ দেখা দেয়। প্রতিকার: সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এড়িয়ে চলুন। সানস্ক্রিন, সানগ্লাস ও টুপি ব্যবহার করুন। চিন্তার কিছু নেই—সন্তান জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই দাগগুলো স্বাভাবিকভাবে মিলিয়ে যেতে পারে। ৬. হিট এক্সোশন গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকলে আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ফলে শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে দেখা দিতে পারে হিট এক্সোশন (Heat Exhaustion) — যা এক ধরনের হাইপারথার্মিয়া বা উচ্চ তাপমাত্রাজনিত স্বাস্থ্যসমস্যা। লক্ষণ: অতিরিক্ত ঘাম। ত্বক ফ্যাকাশে। মাথা ব্যথা, বমি, দুর্বলতা। জ্ঞান হারাতে পারেন। বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া। মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়া ক্লান্তিভাব ও দুর্বল লাগা করণীয়: ঠান্ডা জায়গায় যান। হালকা পানি পান করুন। শরীর ঠান্ডা রাখুন। ঠান্ডা ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছুন। সম্ভব হলে বাথটাবে ঠান্ডা পানিতে বসে থাকুন। ১ ঘণ্টার মধ্যে উন্নতি না হলে দ্রুত হাসপাতালে যান। ৭. হিট স্ট্রোক: মারাত্মক বিপদ হিট স্ট্রোক হলে শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়, যা হার্ট, মস্তিষ্ক, কিডনি বা পেশীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরম লাগা কি স্বাভাবিক? জানুন এর কারণ, প্রতিকার Read More »