Parenting Point

ডেঙ্গু জ্বর

Dengue Fever

ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায় এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে আক্রান্ত করে। অনেক সময় এই রোগটি সাধারণ জ্বর হিসেবেই শুরু হয় এবং বাসায় চিকিৎসায় সেরে ওঠা সম্ভব হয়। তবে কখনো কখনো এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করে প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ শনাক্ত, সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই লেখায় ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, জটিলতা, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ: কখন সতর্ক হবেন?

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। আবার অনেক সময় সাধারণ সর্দিজ্বর ভেবে উপসর্গগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, যার ফলে রোগটি জটিল আকার নিতে পারে। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

কখন লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর সাধারণত ৩–১৪ দিনের মধ্যে (গড়ে ৪–৭ দিন) লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ সময় হঠাৎ করেই উচ্চ জ্বর (১০৪°F পর্যন্ত) দেখা দিতে পারে, সঙ্গে কাঁপুনি ও শরীরব্যাপী অস্বস্তি শুরু হয়।

ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণসমূহ

নিম্নে ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো তুলে ধরা হলো—

  • তীব্র জ্বর (৪০°C বা ১০৪°F পর্যন্ত)।
  • মাথাব্যথা, বিশেষ করে কপালের দিকে।
  • চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব।
  • পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (এ কারণে ডেঙ্গুকে ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ বলা হয়)।
  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
  • শরীরের গ্রন্থি ফোলা (বগল, কুঁচকি বা গলা)।
  • ত্বকে লালচে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি।
  • খাবারে অরুচি ও পেট ব্যথা।

সাধারণত এই উপসর্গগুলো ২–৭ দিন স্থায়ী হয় এবং বেশিরভাগ মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেন।

শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে

শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অনেক সময় ভিন্নরকম হয়। কিছু লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো—

  • শরীরে শক্তি কমে যাওয়া বা দুর্বলতা।
  • ঘুম ঘুম ভাব ও খিটখিটে মেজাজ।
  • বারবার কান্না বা চিৎকার করা।
  • লালচে র‍্যাশ।
  • নাক, মাড়ি বা ত্বকের নিচে রক্তপাত।
  • দিনে ৩ বার বা তার বেশি বমি হওয়া।
  • ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ (মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া)।
  • এক বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

শিশুদের ডেঙ্গু দ্রুত মারাত্মক আকার নিতে পারে। তাই উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসা নিন।

মারাত্মক ডেঙ্গুর লক্ষণ

ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতি ২০ জনে ১ জনের ক্ষেত্রে রোগটি ‘সিভিয়ার ডেঙ্গু’ বা মারাত্মক ডেঙ্গুতে রূপ নিতে পারে। এই অবস্থায় নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে—

  • তীব্র পেটব্যথা বা পেট ফুলে যাওয়া।
  • দিনে ৩ বার বা তার বেশি বমি।
  • রক্তপাত (নাক, মাড়ি, পায়খানা বা প্রস্রাবে রক্ত)।
  • রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া।
  • ত্বকে লাল দাগ বা রক্তপাতের ছোপ।
  • শরীর ঠাণ্ডা, ঘেমে যাওয়া ও ফ্যাকাশে রঙ।
  • দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস ও দুর্বল পালস (নাড়ির গতি)।
  • ঝিমুনি, অজ্ঞান হওয়া বা খিঁচুনি।
  • প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • চোখ বসে যাওয়া ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া।

এই অবস্থায় দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো জরুরি। জ্বর কমলেও উপসর্গ অব্যাহত থাকলে বাড়িতে বসে না থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারা?
  • ছোটো শিশু (বিশেষ করে এক বছরের নিচে)।
  • গর্ভবতী নারী।
  • যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

এসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে সিভিয়ার ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।

কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা সাধারণত সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে পুরোপুরি সেরে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না এবং বাসায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিতে পারে, যেখানে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর সিদ্ধান্ত।

যাদের ক্ষেত্রে দ্রুত হাসপাতালে শরণাপন্ন হতে হবে

নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন, এমনকি মারাত্মক কোনো উপসর্গ প্রকাশ না পেলেও—

  • গর্ভবতী নারী: গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ মায়ের পাশাপাশি অনাগত শিশুর জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
  • এক বছর বা তার কম বয়সী শিশু: শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হওয়ায় দ্রুত অবনতি হতে পারে।
  • বৃদ্ধ বা বয়স্ক ব্যক্তি: বয়সজনিত কারণে ডেঙ্গুর জটিলতা তাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়।
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: স্থূলতা ডেঙ্গুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জটিল করে তুলতে পারে।
  • ক্রনিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি: যেমন—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইলিউর বা কিডনি সমস্যা।
  • রক্তের সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তি: যারা দীর্ঘদিন ধরে রক্তস্বল্পতা বা অন্যান্য রক্তজনিত রোগে ভুগছেন।

এছাড়াও আপনি যদি একাকী বসবাস করেন বা বাসায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন মনে হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই উত্তম। এতে করে আপনাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে এবং হঠাৎ কোনো জটিলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হবে।

কখন ডেঙ্গু জটিল হতে পারে?

ডেঙ্গু জ্বর সেরে যাওয়ার সময়ই সাধারণত মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়, যেমন—

  • হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া।
  • রক্তক্ষরণ।
  • শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করা।

এই সময় রোগীর লক্ষণগুলো খুব সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, পেট ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট বা রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা গেলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য কোন কোন টেস্ট করানো প্রয়োজন?

ডেঙ্গু জ্বর সন্দেহ হলে রোগ নির্ণয়ের জন্য দ্রুত ও সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সময়ে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারলে জটিলতা কমে এবং চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করা যায়। এই আর্টিকেলে আমরা জানব ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রচলিত পরীক্ষাগুলোর বিস্তারিত।

✅ ১. এনএস১ অ্যান্টিজেন (NS1 Antigen) পরীক্ষা

এটি একটি দ্রুত রক্ত পরীক্ষা যা সাধারণত জ্বরের প্রথম দিন থেকেই ডেঙ্গু শনাক্তে কার্যকর। এই পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে।

  • কার্যকারিতা: জ্বর আসার ১ম থেকে ৪র্থ দিন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।
  • সীমাবদ্ধতা: ৪–৫ দিন পর থেকে পরীক্ষাটি নেগেটিভ আসতে পারে, এমনকি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও।
  • মূল্য: বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই টেস্টের নির্ধারিত মূল্য প্রায় ৫০০ টাকা।

✅ ২. ডেঙ্গু IgM ও IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা

এই টেস্ট দুটি রক্তের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করে।

🔸 IgM অ্যান্টিবডি টেস্ট:

  • শুরু করা যায়: জ্বরের ৫ দিন পর থেকে।
  • সবচেয়ে ভালো ফলাফল: জ্বরের ৭ দিন পর।
  • উদ্দেশ্য: সাম্প্রতিক সংক্রমণ শনাক্ত করা।

🔸 IgG অ্যান্টিবডি টেস্ট:

  • উদ্দেশ্য: আগে কখনো ডেঙ্গু হয়েছিল কি না তা বোঝা যায়।
  • মূল্য: ৩০০–৫০০ টাকার মধ্যে।

✅ ৩. সিবিসি (CBC) পরীক্ষা

CBC (Complete Blood Count) পরীক্ষা ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • পরীক্ষায় যা দেখা হয়: রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিটের মাত্রা।
  • ডেঙ্গু হলে: প্লাটিলেট কমে যেতে পারে, হেমাটোক্রিট বেড়ে যেতে পারে—যা রক্তে তরলের ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
  • মূল্য: ১৫০–৪০০ টাকার মধ্যে।
অতিরিক্ত পরীক্ষা (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)

রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ডাক্তার নিচের অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন:

  • ALT/SGPT ও AST/SGOT: যকৃতের কার্যকারিতা মূল্যায়নে।
  • Urine Test (প্রস্রাব পরীক্ষা): শরীরে ডেঙ্গুর প্রভাব জানতে।

ডেঙ্গুর ঘরোয়া চিকিৎসা: উপসর্গ উপশমে কার্যকর কিছু পরামর্শ

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার এখনো নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে স্বাভাবিক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও ঘরোয়া যত্নেই অনেকাংশে উপশম সম্ভব। কিন্তু মারাত্মক ডেঙ্গু বা জটিল উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

নিচে ডেঙ্গুর উপসর্গ হ্রাসে ঘরোয়া কিছু কার্যকর পদ্ধতি তুলে ধরা হলো—

💧 ১. পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ করুন

ডেঙ্গু হলে শরীর থেকে রক্তের জলীয় অংশ বেরিয়ে যায়, যার ফলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতি রোধে রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ানো খুবই জরুরি। যেমন:

  • বিশুদ্ধ পানি।
  • ডাবের পানি।
  • স্যুপ।
  • লেবু পানি।
  • ফলের রস।
  • দুধ।
  • ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS/খাবার স্যালাইন)।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৬–৮ গ্লাস পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পানির পাশাপাশি ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে খাবার স্যালাইন বিশেষ উপকারী।

🛌 ২. পূর্ণ বিশ্রাম নিন

ডেঙ্গুতে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রামই রোগ প্রতিরোধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কাজকর্ম থেকে বিরতি নিয়ে রোগীকে বিশ্রামে থাকতে উৎসাহিত করুন। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্য বা বন্ধুর সহযোগিতা নিন।

টিপস:
মশাবাহিত এই রোগ ছড়ানো ঠেকাতে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন এবং ঘর পরিষ্কার রাখুন।

💊 ৩. সঠিক ওষুধ ব্যবহার করুন

ডেঙ্গু জ্বর বা ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামলই একমাত্র নিরাপদ ওষুধ।
যা করা যাবে না:

  • অ্যাসপিরিন।
  • আইবুপ্রোফেন।
  • অন্যান্য NSAIDs।

এসব ওষুধ রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায় এবং ডেঙ্গু রোগীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

জ্বরের জন্য অতিরিক্ত টিপস:  ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে পারেন—এতে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে।

❗ লক্ষণ গুরুতর হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন

যদি রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত কমে যেতে থাকে, শ্বাসকষ্ট, রক্তপাত, অতিরিক্ত দুর্বলতা, বমি, পেট ব্যথা বা অচেতনতা দেখা যায়—তবে দেরি না করে সরাসরি হাসপাতালে যান।

🍃 পেঁপে পাতার রস – ডেঙ্গুর ঘরোয়া চিকিৎসায় কতটা কার্যকর?

 প্রচলিত বিশ্বাস:

পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট বাড়িয়ে ডেঙ্গুতে উপকার দেয়—এমনটি অনেকেই মনে করেন।

বিজ্ঞান কী বলে:

গবেষণায় দেখা গেছে, পেঁপে পাতার রস কিছু ক্ষেত্রে প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। তবে এখনো এটি ডেঙ্গুর চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ও অনুমোদিত নয়।

যেসব বিষয় এখনো অস্পষ্ট:
  • কতটুকু পরিমাণ খাওয়া নিরাপদ।
  • কোন বয়সে খাওয়া যাবে।
  • কোন প্রক্রিয়ায় বানানো উচিত।

তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পেঁপে পাতার রস গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।

ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায়?

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস নামক মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশা সাধারণত দিনে কামড়ায়, বিশেষ করে সকাল ও বিকেলের দিকে বেশি সক্রিয় থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে এডিস মশা সংক্রমিত হয় এবং পরবর্তীতে যখন এটি অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তির শরীরেও ভাইরাস প্রবেশ করে।

ডেঙ্গু শুধু মশার মাধ্যমে নয়, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারী থেকে গর্ভের শিশুর মধ্যেও ছড়াতে পারে। এতে শিশুর জন্মের আগেই সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং এর ফলে সময়ের আগেই জন্ম, কম ওজন, এমনকি গর্ভকালীন মৃত্যু ঘটতে পারে।

⚠ ডেঙ্গুর জটিলতা

ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরের রক্তের প্লাটিলেট ধ্বংস করে, যার ফলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্লাজমা লিক হয়ে রক্ত ঘন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সব কারণে ডেঙ্গু দ্রুত জটিল অবস্থায় পরিণত হতে পারে, যা প্রাণঘাতীও হতে পারে। তাই জ্বর বা উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

✅ ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

. এডিস মশা দমন

এডিস মশা সাধারণত জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই নিচের বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিন—

  • বাড়ির চারপাশে যেকোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী পানি জমার স্থান পরিষ্কার করুন। যেমন: ফুলদানি, নারকেলের খোসা, পুরোনো টায়ার, পরিত্যক্ত বালতি ইত্যাদি।
  • পানি সংরক্ষণের পাত্র (ট্যাংক, ড্রাম, বালতি) সবসময় ঢেকে রাখুন এবং নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
  • এয়ারকন্ডিশনার ও ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
  • ঘরের টয়লেট, বাথরুম এবং কমোডের ঢাকনা বন্ধ রাখুন, বিশেষ করে যদি আপনি ক’দিনের জন্য বাইরে যান।
  • স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে মশার ওষুধ স্প্রে করুন।

. মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা

  • জানালা ও দরজায় জাল বা নেট ব্যবহার করুন।
  • বাইরে বের হলে লম্বা জামা-প্যান্ট পরুন এবং রেপেলেন্ট ব্যবহার করুন।
  • দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
  • ঘরে মশা মারার জন্য কয়েল, অ্যারোসল, লিকুইড অথবা ইলেকট্রনিক ব্যাট ব্যবহার করতে পারেন।

ডেঙ্গু না কি করোনা?

ডেঙ্গু ও করোনা—উভয়ই ভাইরাসজনিত রোগ এবং জ্বর দিয়ে শুরু হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণের মাধ্যমে এগুলোকে আলাদা করা যায়:

লক্ষণ ডেঙ্গু হলে কোভিড হলে
কাঁপুনি দিয়ে জ্বর
চোখের পেছনে ব্যথা
মাংসপেশিতে ব্যথা
হাড় ও গিরায় ব্যথা
লাল র‍্যাশ (মুখ/গলায়)
গলা ব্যথা
কাশি
শ্বাসকষ্ট
গন্ধ/স্বাদ কমে যাওয়া
ডায়রিয়া

তবে শুধুমাত্র উপসর্গের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া ঠিক নয়। পরীক্ষার মাধ্যমেই চূড়ান্তভাবে ডায়াগনসিস করা উচিত।

⚠ বিশেষ সতর্কতা
  • কেউ যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, তাকে অবশ্যই মশারি টানিয়ে রাখতে হবে। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে মশা অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
  • করোনা ও ডেঙ্গু একসাথে হওয়াও সম্ভব, যা রোগীর জন্য মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করাই একমাত্র পথ।

ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সবচেয়ে বেশি করা প্রশ্নের উত্তর

ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। সময়মতো সঠিক তথ্য জানা জরুরি, যাতে রোগের জটিলতা এড়ানো যায় এবং চিকিৎসার সঠিক পথ নির্ধারণ করা যায়। নিচে ডেঙ্গু সম্পর্কিত সবচেয়ে সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো।

সাধারণত কোনো জটিলতা না থাকলে ডেঙ্গু জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই সময়সীমা একটু দীর্ঘতরও হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরে প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—

  • বিশুদ্ধ পানি।
  • ডাবের পানি।
  • লেবুর শরবত।
  • ফলের রস।
  • খাবার স্যালাইন।

এছাড়া পুষ্টিকর স্বাভাবিক খাবার খাওয়া চলমান রাখতে হবে। বিশেষ কোনো খাদ্যনিষেধ না থাকলেও, তরল খাবারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর জটিল হলে শরীরে প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। তবে:

  • প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন খুব কম ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয়।
  • শুধু মাত্র প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি সাধারণত খুবই কম।
  • পানিশূন্যতা প্রতিরোধ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি।
  • প্লাটিলেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নির্ধারণ করবেন রোগীর সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে।

না, ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানো এডিস মশা পরবর্তী সময়ে অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে।

না। ডেঙ্গু কেবলমাত্র এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস স্ত্রী মশার মাধ্যমে ছড়ায়। অন্য কোনো মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ানোর প্রমাণ নেই।

ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য যেসব টেস্ট করা হয়:

  1. NS1 Antigen টেস্ট।
  2. IgM / IgG Antibody টেস্ট।
  3. CBC (Complete Blood Count)।

হ্যাঁ, গোসল করা যাবে। তবে:

  • ঠাণ্ডা পানি দিয়ে দীর্ঘ সময় গোসল এড়িয়ে চলুন।
  • কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা ভালো।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে গামছা দিয়ে গা মুছে দেওয়া নিরাপদ বিকল্প হতে পারে।

যদি কোনো জটিলতা না থাকে, তবে ঘরেই বিশ্রাম, তরল পানীয় এবং প্যারাসিটামল গ্রহণের মাধ্যমে অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তবে সতর্ক নজরদারি জরুরি—কোনো বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস দূর করার সরাসরি ওষুধ নেই। শুধুমাত্র উপসর্গের চিকিৎসা করা হয়:

  • প্যারাসিটামল: জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য নিরাপদ।
  • অ্যাসপিরিন ও আইবুপ্রোফেন এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে রক্তপাতের ঝুঁকি থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরে এই ওষুধগুলো পরিহার করা উচিত:

  • অ্যাসপিরিন।
  • আইবুপ্রোফেন।
  • যেকোনো স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিক (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া)।

হ্যাঁ, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। একবার আক্রান্ত হলে সেই সেরোটাইপ থেকে ভবিষ্যতে সুরক্ষা পাওয়া গেলেও, অন্য সেরোটাইপ দ্বারা আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এডিস মশার কামড়ের পর ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে (গড় ৪–৭ দিন) হঠাৎ করে জ্বর শুরু হতে পারে। তখন শরীরের তাপমাত্রা ১০২–১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *