জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা সবসময়ই একটু বেশিই বিশেষ। ঠিক তেমনই, শিশুর প্রথম ১২ মাস—এই সময়টা তার বেড়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হাঁটতে শেখা, নিজের নাম শুনে সাড়া দেওয়া, মায়ের কোলে লজ্জা পাওয়া কিংবা ছোট ছোট শব্দে কথা বলা—প্রতিটি মুহূর্তই এক একটি মাইলফলক। এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে, শিশুর ১ বছর বয়সের মধ্যে কোন কোন রোমাঞ্চকর বিকাশ আমরা আশা করতে পারি এবং কীভাবে প্রতিটি শিশু নিজের গতিতে বেড়ে ওঠে।
১ বছর বয়সী শিশুর চলাফেরার মাইলফলক
শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপই এক একটি অনন্য মাইলফলক। ১ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়েই শিশুর মোটর স্কিল বা চলাফেরার দক্ষতা গড়ে ওঠে। শিশুর মোটর স্কিল বলতে বোঝায় তাদের শরীরের নড়াচড়া, বসা, হামাগুড়ি দেওয়া এবং হাঁটার মতো শারীরিক কর্মকাণ্ডের দক্ষতা। এই সময় শিশুরা নিচের কয়েকটি মাইলফলকে পৌঁছাতে শুরু করে:
✅ নিজে বসে থাকতে পারবে
প্রথম দিকে (৪-৫ মাস বয়সে) শিশু হেলান দিয়ে বসা শিখে ফেলে। কিন্তু বয়স ৯-১২ মাসে পৌঁছালে, সে আর কোনো কিছুতে ভর না দিয়েই নিজেই উঠে বসে থাকতে পারে। এটি শিশুর শরীরের পেশি নিয়ন্ত্রণে উন্নতির একটি বড় ইঙ্গিত।
✅ হামাগুড়ি দিয়ে আগানো
সব শিশু হামাগুড়ি দেয় না, তবে অধিকাংশই পেটের ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে। পরে হাত ও পায়ের ওপর ভর দিয়ে পুরোদমে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শেখে। এটি শিশুর সমন্বয় ক্ষমতা এবং শক্তি বৃদ্ধির লক্ষণ।
✅ নিজে উঠে দাঁড়ানো
যখন আপনি দেখবেন শিশুটি ছোট চেয়ার বা টেবিলের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারছে, বুঝবেন সে হাঁটার প্রস্তুতিতে রয়েছে। এই ধাপে শিশুরা পা ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখে – হাঁটার আগের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
✅ গুটি গুটি পায়ে হাঁটার চেষ্টা
১ বছর বয়সেই অনেক শিশু বড়দের হাত ধরে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করে। যদিও প্রতিটি শিশুর বিকাশ ভিন্ন, তবে অধিকাংশ শিশু ১৮ মাস বয়সের মধ্যে একা একা হাঁটতে শেখে। এটা শিশুর আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীন চলাফেরার দিকে বড় একটি ধাপ।
১ বছর বয়সী শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক মাইলফলক
এক বছর বয়সে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়। এ বয়সে শিশুরা নতুন জিনিস শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, চারপাশের জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে শেখে এবং নিজের মতো করে ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। এই সময়ের অর্জিত প্রতিটি মাইলফলক তার মস্তিষ্কের বিকাশ ও চিন্তাশক্তির অগ্রগতিকে নির্দেশ করে।
জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখবে
এক বছরের শিশুরা প্রায়ই হাতের কাছে যেটা পায়, সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে। তারা আবিষ্কার করতে চায় জিনিসটি কীভাবে কাজ করে কিংবা সেটি দিয়ে কী করা যায়। এই বয়সে শিশুরা ঘরের জিনিস নাড়িয়ে দেখা, ছুঁড়ে মারা বা আছাড় দিয়ে ফেলার মাধ্যমে শিখে নেয় কারণ-প্রতিক্রিয়ার ধারণা।
লুকিয়ে রাখা জিনিস খুঁজে বের করতে পারবে
আপনার শিশু যদি কাঁথার নিচে রাখা তার প্রিয় খেলনাটি খুঁজে বের করতে পারে, বুঝে নিন সে এখন বস্তু স্থায়ীত্বের ধারণা (object permanence) রপ্ত করছে। এটি শিশুদের চিন্তাশক্তির একটি বড় অগ্রগতি।
জিনিসপত্র বাক্সে রাখতে পারবে
শিশুরা এখন ছোট ছোট জিনিস একত্র করে একটি বাক্সে রাখতে শিখে। যদিও কখনো কখনো আবার সেগুলো ছড়িয়ে দিতেও পারে, তবে এভাবেই তারা সংগঠন ও ধারাবাহিকতার ধারণা অর্জন করে।
জিনিস ঠিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করবে
এক বছর বয়সী শিশু সাধারণ ব্যবহারের জিনিস যেমন কাপ, চামচ বা খেলনা ঠিকভাবে ধরতে ও ব্যবহার করতে শিখে। কাপ থেকে নিজে পানি খাওয়ার চেষ্টা বা চামচে করে খাবার তোলার চেষ্টাও দেখা যায় এই সময়।
সহজ নির্দেশনা পালন করতে পারবে
“খেলনাটা মাটিতে রাখো”, “মামাকে টাটা দাও”— এমন ছোট ছোট নির্দেশনার প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করে এই বয়সী শিশুরা। তারা শব্দ ও নির্দেশনা বুঝতে শেখে, যা তাদের ভাষা ও সামাজিক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।
১ বছর বয়সী শিশুর ভাষা ও যোগাযোগের মাইলফলক
শিশুর প্রথম জন্মদিনের কাছাকাছি সময়টা শুধু কেক-ক্যান্ডল দিয়ে উদ্যাপন করার নয়—এটা তার ভাষা ও যোগাযোগের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বয়সে শিশুরা নানা রকম শব্দ, আওয়াজ এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি ও চাহিদা প্রকাশ করতে শেখে। নিচে ১ বছর বয়সী শিশুর ভাষাগত ও যোগাযোগমূলক বিকাশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক তুলে ধরা হলো—
অর্থহীন আওয়াজ ও ছোট ছোট শব্দ উচ্চারণ
১ বছর বয়সের দিকে এগোতে থাকা শিশুরা সারাদিন অর্থহীন আওয়াজ করতে থাকে। “ডা ডা”, “টা টা”, “মা মা” বা “বাবা” জাতীয় ছোট শব্দগুলো প্রথম উচ্চারণে শোনা যেতে পারে। যদিও এসব শব্দে এখনো তেমন অর্থ নেই, তবুও এগুলো ভবিষ্যতের ভাষা শেখার ভিত্তি তৈরি করে।
ইঙ্গিতের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ
এই বয়সে শিশুরা ইঙ্গিত শেখে এবং ব্যবহার করতে শুরু করে। বিদায় জানাতে হাত নাড়া, কিছু না চাইলে মাথা নাড়ানো বা আনন্দ পেলে হাততালি দেওয়া—এসবই তার যোগাযোগ দক্ষতার অংশ। শিশুর ইঙ্গিত ব্যবহার তার সামাজিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
গলার স্বরের বৈচিত্র্য
শিশু এ সময় বিভিন্ন স্বরের ভঙ্গিমা অনুকরণ করে—নরম আওয়াজ থেকে শুরু করে উচ্চস্বরে ‘আবোল তাবোল’ বলা পর্যন্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে এমনভাবে আওয়াজ করে যেন আপনাকে কিছু বলতে চাইছে। এ সময় তার স্বরেও ওঠানামা লক্ষ্য করা যায়, যা বড়দের মতো কথা বলার এক ধরনের অনুশীলন।
কীভাবে শিশুকে কথা শেখাতে সাহায্য করবেন?
১ বছর বয়সে শিশুরা সাধারণত কয়েকটি সহজ শব্দ উচ্চারণ করতে শেখে—যেমন: “মা”, “উহু”, “বাবা” ইত্যাদি। এ সময় আপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে নিয়মিতভাবে তার নাম ধরে ডাকা, তার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা এবং ছোট ছোট শব্দ বারবার বলার মাধ্যমে সে দ্রুত শব্দ ও ভাষা শিখে নিতে পারে।
সহজ কিছু পরামর্শঃ
- শিশুকে গান, ছড়া ও গল্প শুনান।
- শিশুর প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিন।
- তার বলা অর্থহীন শব্দগুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে জবাব দিন।
- বারবার একই শব্দ ব্যবহার করে শেখানোর চেষ্টা করুন।
১ বছর বয়সের শিশুর সামাজিকতা ও আবেগের মাইলফলক
শিশু যখন ১ বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন তার ব্যক্তিত্ব ও আবেগের জগতে আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এ সময় সে শুধু হাঁটা বা শব্দ বলা শিখছে না, বরং ধীরে ধীরে তৈরি করছে সামাজিক সংযোগ ও জটিল আবেগগত প্রতিক্রিয়া। চলুন জেনে নিই এই বয়সে শিশুর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও আবেগের মাইলফলক সম্পর্কে।
চোখে চোখ রেখে হাসা – সম্পর্ক তৈরির শুরু
১ বছর বয়সী শিশু যদি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে, তাহলে বুঝে নিন সে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রাথমিক ধাপ পার করছে। এটি তার সামাজিক বিকাশের এক শক্তিশালী ইঙ্গিত।
অপরিচিত মানুষ দেখলে অস্থিরতা – স্ট্রেইঞ্জার অ্যাংজাইটি
এই বয়সে অপরিচিত কেউ কাছে এলে অনেক শিশুই অস্থির বা লাজুক হয়ে পড়ে, এমনকি কান্নাও শুরু করে দেয়। এটিকে বলা হয় Stranger Anxiety বা অপরিচিত ভীতি। যদিও এটি সাধারণত ৯ মাস বয়সে শুরু হয়, তবে অনেক শিশুর ক্ষেত্রে এটি দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
হাত তালি দিয়ে খেলায় অংশগ্রহণ
১ বছর বয়সে শিশু সাধারণত ছন্দ মিলিয়ে হাত তালি দিতে পারে। এ ধরনের খেলার মাধ্যমে সে আনন্দ প্রকাশ করে এবং সামাজিকভাবে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে শেখে।
পছন্দের জিনিস ও প্রিয় মানুষের প্রতি আগ্রহ
এ বয়সে শিশু নির্দিষ্ট কিছু খেলনা বা ব্যক্তি পছন্দ করতে শুরু করে। হয়তো কোনো একটি খেলনা প্রতিদিনই তার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে মা-বাবার সান্নিধ্যে সে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করে।
নিজে থেকেই গল্পের বই এগিয়ে দেবে
১ বছর বয়সী শিশুরা গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। পরিচিত ছবি যেমন হাতি, ঘোড়া বা ফুলের নাম বললে শিশুরা ছবির দিকেই তাকায়। এমনকি ঘুমানোর সময় কোন বইটি পড়বেন, সেটিও হয়তো সে নিজেই পছন্দ করে এগিয়ে দেবে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত?
প্রত্যেক শিশুই নিজের ছন্দে বড় হয়—কারো একটু আগে, কারো একটু পরে। তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতা না দেখা গেলে তা হতে পারে বিকাশজনিত একটি সংকেত। এমন ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
১২ মাস পূর্ণ হওয়ার পর যদি লক্ষ্য করেন—
আপনার শিশু যদি নিচের যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ দেখায়, তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা ভালো:
- হামাগুড়ি দিতে না পারা বা হামাগুড়ির সময় একদিকে হেলে পড়া। যদিও কিছু শিশু হামাগুড়ি না দিয়ে সরাসরি দাঁড়াতে শেখে, তবুও অস্বাভাবিক আচরণ হলে নজর দিন।
- কোনো কিছুর ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে না পারা।
- খেলার ছলে কিছু লুকানো হলে তা খুঁজতে আগ্রহ না দেখানো।
- সহজ ধ্বনি (যেমন মা, বা) উচ্চারণ না করা।
- হাত নাড়ানো, মাথা নাড়ানো, না বলা বা কিছু দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা না করা।
- ছবি বা কোন বস্তু দেখিয়ে আগ্রহ প্রকাশ না করা।
১৮ মাস পূর্ণ হওয়ার পর যদি লক্ষ্য করেন—
এই বয়সে শিশুরা সাধারণত হাঁটা শেখে ও কথা বলার প্রাথমিক ধাপ শুরু করে। নিচের লক্ষণগুলো থাকলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন:
- হাঁটা শুরু না করা।
- আঙুল দিয়ে কোনো কিছুর দিকে দেখানো না শেখা।
- বড়দের নকল করে কথা বলার চেষ্টা না করা।
- চেনা জিনিসের ব্যবহার না বোঝা (যেমন চামচ, বালিশ ইত্যাদি)।
- কমপক্ষে ৬টি সহজ শব্দ (যেমন মা, বাবা,দাদা, বাই বাই) বলতে না পারা।
- আগে শেখা কোনো দক্ষতা ভুলে যাওয়া (যেমন নিজে গ্লাসে পানি খাওয়া)।
শিশুর বিকাশের এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ
১ থেকে ২ বছর বয়সের মধ্যে শিশুর বিকাশ হয় খুব দ্রুত। তারা হাঁটতে শেখে, নতুন শব্দ বলতে শুরু করে, আপনার কথা অনুকরণ করে এবং আশেপাশের জগৎকে জানার চেষ্টা করে। প্রতিদিনই সে নতুন কিছু শিখবে। এ সময়টাতে শিশুর বিকাশে সহায়তা করতে হলে তার আচরণ ও সক্ষমতার ওপর নিয়মিত নজর রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।
👶 আপনার আদরের সন্তানের প্রতিটি মাইলফলক আপনার জন্য আনন্দের উৎস। আর তাই, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটাই হতে পারে তার সুস্থ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
মনে রাখুন:
শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথে যেকোনো সন্দেহজনক লক্ষণ অবহেলা না করে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সচেতনতাই পারে আগেভাগে সমস্যা শনাক্ত করে তার সমাধান করতে।