সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর জন্য স্বাভাবিক (নরমাল) ডেলিভারি অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ ও উপকারী। তবে বর্তমান সময়ে নানা শারীরিক ও জীবনধারাগত কারণে অনেক নারীকেই সিজারিয়ান ডেলিভারির দিকে ঝুঁকতে হয়। গর্ভকালীন কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত চেকআপ—এসবই একটি নিরাপদ ও নরমাল ডেলিভারিকে উৎসাহিত করতে পারে। এই লেখায় এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে, যা মেনে চললে স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব।
নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়াতে করণীয়
প্রাকৃতিক বা নরমাল ডেলিভারি, মায়ের জন্য যেমন নিরাপদ, তেমনি শিশুর জন্যও তা স্বাস্থ্যকর। তবে বর্তমান সময়ে নানা জটিলতা ও জীবনধারাগত কারণে অনেক মায়ের ক্ষেত্রেই সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন পড়ে। অথচ গর্ভকালীন সময়ে কিছু সচেতনতা ও সহজ পরিবর্তনের মাধ্যমেই নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব।
নরমাল ডেলিভারির পথে বাধাগুলো
গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের সময় কিছু জটিলতা নরমাল ডেলিভারিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। যেমন:
- গর্ভধারণের আগে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
- গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ও দ্রুত ওজন বৃদ্ধি।
- ৩৫ বছর বয়সের পরে গর্ভধারণ।
- ডায়াবেটিস বা রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন।
- উচ্চ রক্তচাপ।
- শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও মানসিক চাপ।
এই সব কারণই নরমাল ডেলিভারির ঝুঁকি বাড়ায় এবং সিজার প্রয়োজনীয় করে তোলে।
নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়াতে করণীয়
জীবনধারায় কিছু সহজ ও কার্যকর পরিবর্তন এনে মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই একটি নিরাপদ ও স্বাভাবিক ডেলিভারির পথ প্রশস্ত করা যায়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
১. সঠিক ওজন বজায় রাখা
গর্ভধারণের আগে ও গর্ভাবস্থায় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ এড়িয়ে চলা উচিত।
২. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা হাঁটা, গর্ভকালীন ইয়োগা বা প্রেনাটাল এক্সারসাইজ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি শরীরকে ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত রাখে।
৩. মানসিক চাপ কমানো
অতিরিক্ত মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে প্রসব জটিল করে তুলতে পারে। তাই মেডিটেশন, সঙ্গীত বা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সাথে সময় কাটিয়ে মানসিক স্বস্তি বজায় রাখা জরুরি।
৪. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
ফলমূল, সবজি, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, পর্যাপ্ত পানি ইত্যাদি নিয়মিত গ্রহণ করলে গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি বজায় থাকে এবং গর্ভজনিত জটিলতা হ্রাস পায়।
৫. প্রসব–পূর্ব ম্যাসাজ
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন সময়ে যোনিপথে হালকা ম্যাসাজ করলে যন্ত্রণার পরিমাণ কমে এবং এপিসিওটমি বা সেলাইয়ের প্রয়োজন অনেকাংশে কমে যায়। এটি স্বাভাবিক প্রসবকে সহজ করতে সাহায্য করে।
৬. ধূমপান ও ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে বিরত থাকা
ধূমপান, অ্যালকোহল বা কোনো ধরনের মাদকসেবন মা ও শিশুর উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো স্বাভাবিক ডেলিভারির সম্ভাবনা হ্রাস করে।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম
সুস্থ গর্ভাবস্থার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম আবশ্যক। শরীর ও মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটি বিশেষভাবে সহায়ক।
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম: সুস্থ মা ও শিশুর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস
গর্ভাবস্থার সময় স্বাস্থ্যবান থাকা শুধুমাত্র মায়ের জন্যই নয়, গর্ভের শিশুর সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত জরুরি। আর এই সুস্থতা বজায় রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম একটি কার্যকর ও নিরাপদ উপায় হিসেবে বিবেচিত।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় যেসব মা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং সিজারিয়ান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজন অনেকটাই কমে যায়। এছাড়াও, সময়ের আগে সন্তান প্রসব এবং কম ওজনের শিশুর জন্ম হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পায়।
কেন ব্যায়াম জরুরি গর্ভাবস্থায়?
নিয়মিত ব্যায়াম গর্ভকালীন অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। অতিরিক্ত ওজন শিশুর আকার বড় করে তুলতে পারে, যা সিজারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও ব্যায়াম গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়া এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়—যা সবই সম্ভাব্য জটিল প্রসবের কারণ হতে পারে।
ব্যায়ামের উপকারিতা এক নজরে:
- কোমর ব্যথা ও অন্যান্য গর্ভকালীন ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের সমস্যা হ্রাস করে।
- শরীরের শক্তি ও সহ্যশক্তি বাড়ায়।
- মন ভালো রাখতে সহায়তা করে।
- ভালো ঘুম আসতে সাহায্য করে।
কতটা ব্যায়াম করা উচিত?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রতি সপ্তাহে ২.৫ ঘণ্টা মাঝারি মাত্রার ‘অ্যারোবিক’ ব্যায়াম উপযোগী। উদাহরণস্বরূপ:
- দ্রুত হাঁটা।
- বাগান করা।
- সাঁতার কাটা।
- হালকা নাচ।
- সাইকেল চালানো (নিরাপদ স্থানে)।
আপনি সপ্তাহে পাঁচ দিন, দিনে ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করতে পারেন। আবার চাইলে দিনে তিন ভাগে ১০ মিনিট করে শরীরচর্চাও করতে পারেন। যেটা আপনার জন্য বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হয়, সেটাই বেছে নিন।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
যদি গর্ভধারণের আগে আপনার ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকে, তবুও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ধীরে ধীরে হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে শুরু করুন এবং সময়ের সাথে সহনশীলতা বাড়ান। আপনার প্রতিদিনের রুটিনেই সহজ কিছু শারীরিক কার্যকলাপ যোগ করুন—যেমন: সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, দোকানে যাওয়ার সময় কিছুটা হাঁটা ইত্যাদি।
কোন ব্যায়াম থেকে বিরত থাকবেন?
গর্ভাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যায়াম যেমন—বক্সিং, ব্যাডমিন্টন, কারাতে ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই ভালো। ভারী ধরনের নতুন এক্সারসাইজ শুরু করাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আপনার শারীরিক অবস্থা ও গর্ভকালীন জটিলতা অনুযায়ী ব্যায়াম নির্বাচনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া: সুস্থ মা ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
গর্ভাবস্থায় আপনি যা খান, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে আপনার অনাগত সন্তানের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের উপর। অনেকেরই ধারণা, গর্ভধারণ করলেই ‘দুইজনের হয়ে খেতে হবে’। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি ভুল ধারণা। দুইজনের হয়ে নয়, বরং একজনের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য নির্বাচনই যথেষ্ট।
গর্ভাবস্থায় খাদ্য নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত চিনি, তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার থেকে দূরে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
- অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি যেমন ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি অপুষ্টিও অনাগত শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে হলে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি, শাকসবজি, ফলমূল, প্রোটিন ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।
কোন মাসে কতটুকু অতিরিক্ত ক্যালরি প্রয়োজন?
গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে আপনার ক্যালরির প্রয়োজন পরিবর্তিত হয়:
- প্রথম তিন মাসে (প্রথম ত্রৈমাসিক) – সাধারণত অতিরিক্ত খাবারের প্রয়োজন নেই।
- দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (৪–৬ মাস) – প্রতিদিন গড়ে ৩৪০ ক্যালরি অতিরিক্ত প্রয়োজন।
- তৃতীয় ত্রৈমাসিক (৭–৯ মাস) – প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ ক্যালরি অতিরিক্ত খাবার প্রয়োজন।
📌 এই ক্যালরি মান সাধারণভাবে স্বাভাবিক ওজনের একজন মায়ের জন্য প্রযোজ্য। ওজন কম বা বেশি হলে, কিংবা যমজ সন্তান ধারণ করলে এই হিসাব পরিবর্তিত হবে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় যা রাখবেন:
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার (ক্যালসিয়ামের উৎস)।
- ডিম ও মাছ (প্রোটিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস)।
- ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল (আঁশ, আয়রন, ভিটামিন)।
- বাদাম ও বীজ (স্বাস্থ্যকর চর্বি)।
💡 গুরুত্বপূর্ণ টিপস:
- অতিরিক্ত খাওয়া নয়, বরং সঠিক পরিমাণে খাওয়া জরুরি।
- চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে ঘরে রান্না করা খাবারে গুরুত্ব দিন।
- প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখুন।
নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপ: সুস্থ মা ও শিশুর জন্য অপরিহার্য
গর্ভাবস্থার প্রতিটি মুহূর্ত একটি নারীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। এই সময়টায় মা ও গর্ভের শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপে যাননি, তাদের মধ্যে প্রসবকালীন জটিলতা, সিজারিয়ানের ঝুঁকি ও মাতৃমৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
কেন প্রয়োজন নিয়মিত চেকআপ?
গর্ভকালীন চেকআপের মাধ্যমে মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে করে নিচের সুবিধাগুলো পাওয়া যায়:
- গর্ভকালীন জটিলতা আগে থেকেই শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা যায়।
- নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়ে, কারণ অনেক সমস্যাই আগেভাগে প্রতিরোধ করা যায়।
- মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমে আসে নিয়মিত চিকিৎসা ও নজরদারির ফলে।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৫৮১, যা ২০১৭ সালে কমে হয়েছে ১৭৩। একইভাবে ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে নবজাতক মৃত্যুহার ছিল ৬৫, যা ২০২০ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৭-তে। এই উন্নতির পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপ।
কখন শুরু করবেন চেকআপ?
গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব প্রথম চেকআপ করিয়ে ফেলা উচিত, তবে ১২তম সপ্তাহের আগে এটি করানো অত্যাবশ্যক। ডাক্তার গর্ভবতী মায়ের শারীরিক অবস্থা এবং গর্ভের শিশুর বিকাশের ভিত্তিতে একটি ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করে দেন।
কী থাকে গর্ভকালীন চেকআপে?
চেকআপের অংশ হিসেবে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, ডায়াবেটিস পরীক্ষা।
- আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে শিশুর অবস্থান ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ।
- খাবার ও পুষ্টির দিকনির্দেশনা।
- প্রয়োজনীয় টিকা ও সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ।
- মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ।
সঠিক মাত্রায় ওজন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা: সুস্থ গর্ভাবস্থার প্রথম ধাপ
গর্ভাবস্থায় সঠিক মাত্রায় ওজন বৃদ্ধি শুধু মায়ের নয়, গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওজন যদি খুব কম বা খুব বেশি হারে বাড়ে, তবে তা হতে পারে মা ও শিশুর জন্য নানা জটিলতার কারণ। যেমন – জটিল ডেলিভারি, সিজারিয়ান প্রসবের ঝুঁকি, কিংবা শিশুর জন্মের পর বিশেষ চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয়তা।
অতিরিক্ত বা কম ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি
- গর্ভাবস্থায় ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং সিজারিয়ান ডেলিভারির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- অপরদিকে, ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম বাড়লে শিশুর ওজন কম হওয়া, অপরিণত জন্ম বা জন্ম পরবর্তী জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কী হারে ওজন বাড়া উচিত?
প্রত্যেক নারীর জন্য গর্ভাবস্থায় আদর্শ ওজন বৃদ্ধির হার ভিন্ন হয়। এটি নির্ভর করে গর্ভধারণের আগে মায়ের ওজন ও বিএমআই (BMI) কত ছিল তার ওপর।
সাধারণভাবে:
গর্ভধারণ পূর্ববর্তী BMI | মোট ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা |
কম (BMI < 18.5) | ১২.৫–১৮ কেজি |
স্বাভাবিক (18.5–24.9) | ১১.৫–১৬ কেজি |
বেশি (25–29.9) | ৭–১১.৫ কেজি |
স্থূল (BMI ≥ 30) | ৫–৯ কেজি |
ধীরে ধীরে ওজন বাড়ানোই শ্রেয়
গর্ভধারণের প্রথম ত্রৈমাসিক (১–১২ সপ্তাহ) ওজন বৃদ্ধি খুব কম হতে পারে বা নাও হতে পারে, যা স্বাভাবিক। তবে ১৩তম সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকা উচিত, যাতে মায়ের শরীর ও শিশুর বৃদ্ধি ধাপে ধাপে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
নিয়মিত ওজন পরিমাপের অভ্যাস গড়ুন
- প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিনে ও সময় ওজন মাপুন।
- সকালবেলা, খালি পেটে ও একই পোশাকে ওজন নেওয়াই উত্তম।
- ওজন বৃদ্ধির ধারা ট্র্যাক করে রাখুন – ডায়েরি বা মোবাইল অ্যাপে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
আপনার ওজন ঠিক হারে বাড়ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো গর্ভকালীন চেকআপে চিকিৎসকের মতামত নেওয়া। যদি ওজন বৃদ্ধি অনিয়মিত হয়, তাহলে চিকিৎসকের সহায়তায় পুষ্টিকর খাদ্যতালিকা ও ব্যায়ামের একটি নিরাপদ রুটিন ঠিক করে নিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার গুরুত্ব
— স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণের জন্য মানসিক শান্তির দিকটি উপেক্ষা করবেন না
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে এই সময়টি শুধু শারীরিক পরিবর্তনের নয়, মানসিক দিক থেকেও বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। হরমোনজনিত ওঠানামা, ভবিষ্যতের চিন্তা, পারিবারিক চাপ কিংবা আশেপাশের পরিবেশ—সব মিলিয়ে মনের ওপর চাপ তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই মানসিক চাপ যদি দীর্ঘস্থায়ী বা অতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলে তা মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কেন মানসিক চাপ কমানো জরুরি?
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মানসিক চাপ গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, অকাল প্রসব এবং শিশুর জন্মের পর মানসিক ও শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থার সময় যতটা সম্ভব মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকা আপনার ও আপনার শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক চাপ কমানোর কার্যকর কিছু উপায়:
✅ পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন:
আপনার অনুভূতি, ভয় বা উদ্বেগ সম্পর্কে কাছের মানুষদের জানান। চাপ ভাগ করে নিলে তা অনেকটাই হালকা লাগে।
✅ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
যদি মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা গাইনি চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
✅ যোগব্যায়াম ও শ্বাস–প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন:
নিয়মিত ইয়োগা ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ মানসিক প্রশান্তি আনতে দারুণ কার্যকর।
✅ নিজেকে সময় দিন:
ডায়েরি লেখার অভ্যাস, প্রিয় গান শোনা, বই পড়া বা হালকা হাঁটাহাঁটি—আপনার যা ভালো লাগে, তাই করুন। নিজেকে ভালো রাখাটা এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
✅ পজিটিভ চিন্তা করুন:
ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলো কল্পনা করুন। প্রতিদিন নিজের সঙ্গে ইতিবাচক কথা বলুন।
গর্ভকালীন বিশেষ স্বাস্থ্য পরামর্শ মেনে চলা
একটি সুস্থ ও নিরাপদ গর্ভধারণের জন্য শুধুমাত্র নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শই নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও অত্যন্ত জরুরি। গর্ভধারণের আগে থেকেই যদি কিছু সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা যায়, তাহলে তা মায়ের শরীর ও গর্ভের শিশুর সুস্থতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
নিচে গর্ভকালীন সময়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরামর্শ তুলে ধরা হলো—
✅ গর্ভধারণের পরিকল্পনা শুরু থেকেই আয়রন-ফলিক অ্যাসিড
যখনই আপনি গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছেন, তখন থেকেই নিয়মিত আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ শুরু করা উচিত। এটি নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা প্রতিরোধে কার্যকর।
✅ কাজের সময় ভারী জিনিস তোলা ও একটানা দাঁড়িয়ে থাকা এড়িয়ে চলুন
দীর্ঘ সময় ধরে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা বা ভারী কোনো জিনিস তোলার ফলে পেটের নিচে চাপ পড়ে, যা গর্ভধারণে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই কাজের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
✅ পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম
প্রতিদিন ৭–৯ ঘণ্টা গভীর রাতের ঘুম নেওয়া গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বিশ্রাম শরীরের হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ক্লান্তি দূর করে।
✅ গর্ভাবস্থার বিপদচিহ্ন সম্পর্কে সচেতনতা
রক্তপাত, তলপেটে তীব্র ব্যথা, বাচ্চার নড়াচড়ার পরিবর্তন—এসব বিপদচিহ্ন দেখা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সচেতনতা এবং দ্রুত পদক্ষেপ প্রাণরক্ষা করতে পারে।
✅ অতিরিক্ত ক্যাফেইন থেকে বিরত থাকুন
গর্ভকালীন সময়ে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সাধারণত ২ কাপ কফি বা ২-৩ কাপ চায়ে এই মাত্রার ক্যাফেইন থাকতে পারে। তাই চা-কফি গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
✅ ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন
ধূমপান ও মদ্যপান গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে, এমনকি গর্ভপাত ও মৃত সন্তানের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। তাই এগুলো সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া উচিত।
✅ গর্ভকালীন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পর্কে সচেতন হোন
সব কাজ গর্ভবতী নারীর জন্য নিরাপদ নয়। আপনি যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে জেনে নিন কোন ধরণের কাজ এই সময় ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমাদের আর্টিকেল: [গর্ভাবস্থায় চাকরি – কি করবেন, কি করবেন না] (এই অংশে আপনি লিংক দিতে পারেন)।
কেগেল এক্সারসাইজ: গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পর পেলভিক ফ্লোরকে শক্তিশালী রাখুন
আমাদের দুই পায়ের মাঝখানে থাকা একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ পেশির সমষ্টিকে পেলভিক ফ্লোর বলা হয়। এই পেশিবহুল স্তর জরায়ু, মূত্রথলি ও অন্ত্রকে সঠিকভাবে ধরে রাখে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় বাড়ন্ত জরায়ুকে সাপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে এই পেশিগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেন কেগেল এক্সারসাইজ করবেন?
প্রসবের সময় পেলভিক ফ্লোরের পেশিগুলোর প্রসারণ ঘটে এবং অনেক সময় তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে হাঁচি, কাশি, বা ভারী কিছু তোলার সময় অনিচ্ছাকৃত প্রস্রাব বেরিয়ে আসা (urinary incontinence)–এর মতো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
নরমাল ডেলিভারির পর এই সমস্যা অনেকের মাঝেই দেখা যায়। তবে গর্ভাবস্থার সময় থেকেই নিয়মিত কেগেল এক্সারসাইজ করলে পেলভিক ফ্লোরের পেশিগুলো দৃঢ় ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকে, ফলে ভবিষ্যতের এই ধরনের সমস্যাগুলো এড়ানো যায়।
কীভাবে করবেন কেগেল এক্সারসাইজ?
‘কেগেল এক্সারসাইজ’ বা ‘পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ’ খুব সহজ একটি ব্যায়াম যা আপনি দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে যেকোনো ভঙ্গিতেই করতে পারেন। এই ব্যায়ামের মূল উদ্দেশ্য হলো — মূত্র থামানোর মতো করে কিছু সময় পেশিগুলো শক্ত করে রাখা এবং পরে ছেড়ে দেওয়া। দিনে কয়েকবার এই ব্যায়াম করলে ধীরে ধীরে পেলভিক ফ্লোর শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ:
নরমাল ডেলিভারিকে সহজ ও স্বস্তিদায়ক করতে একটি কার্যকর পদ্ধতি
আপনার মাতৃত্বযাত্রাকে আরও নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী করতে জেনে নিন এই প্রাক–প্রসব প্রস্তুতির কৌশলটি
গর্ভাবস্থার শেষদিকে এসে অনেক মা নরমাল ডেলিভারির কথা শুনলেই ভয় পেয়ে যান। প্রসবের সময় ব্যথা, যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়া বা সেলাইয়ের চিন্তা অনেক সময় মায়েদেরকে স্বেচ্ছায় সিজারিয়ানের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু কিছু সহজ প্রস্তুতি গ্রহণ করে নরমাল ডেলিভারির অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ, নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক করে তোলা সম্ভব—এরই একটি হলো পেরিনিয়াল ম্যাসাজ।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ কী?
পেরিনিয়াল ম্যাসাজ হচ্ছে একটি বিশেষ ধরণের হালকা ম্যাসাজ পদ্ধতি, যা যোনি ও পায়ুর মাঝামাঝি অংশে (যাকে পেরিনিয়াম বলা হয়) করা হয়। সাধারণত এই ম্যাসাজ ৩৪ সপ্তাহ গর্ভধারণের পর থেকে শুরু করা যায়, তবে অবশ্যই এটি করার আগে গাইনোকলজিস্ট বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নেয়া উচিত।
ম্যাসাজের সময় আঙুল দিয়ে যোনিপথের ২–৩ সেন্টিমিটার ভেতরে প্রবেশ করে পেরিনিয়াম অংশে হালকা টান ও চেপে নির্দিষ্ট নিয়মে ম্যাসাজ করা হয়।
পেরিনিয়াল ম্যাসাজের উপকারিতা
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পেরিনিয়াল ম্যাসাজ করলে—
- যোনিপথে ডেলিভারিজনিত টিস্যু ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি কমে।
- এপিসিওটমি (ডেলিভারির সময় যোনি কেটে বড় করা) প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়।
- সেলাই লাগার সম্ভাবনা কমে।
- প্রসবের সময় ব্যথা ও চাপ কম অনুভূত হয়।
- আত্মবিশ্বাস ও মানসিক প্রস্তুতি বাড়ে।
কখন ও কীভাবে করবেন?
- সপ্তাহে ৩–৪ দিন ম্যাসাজ করা যেতে পারে।
- প্রতিবার ৫–১০ মিনিট করে সময় দিন।
- পরিষ্কার হাতে ও প্রয়োজনে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করে করুন।
- স্বামী/পার্টনারের সহায়তায় করলেও সমস্যা নেই।
তবে যাদের যোনিপথে সংক্রমণ, রক্তপাত বা প্লাসেন্টা-সংক্রান্ত জটিলতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ম্যাসাজ পরিহার করাই ভালো—সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।