নবজাতকের জন্য মায়ের দুধ হচ্ছে প্রকৃতির এক অনন্য উপহার, যা শিশুর প্রথম খাদ্য হিসেবে তার সঠিক পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করে। মায়ের দুধ শিশুর জন্মের পর থেকেই তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুধের প্রতিটি ফোঁটায় মিশে আছে শিশুর সঠিক বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান। মায়ের দুধ ০২ ভাগে বিভক্তঃ
· ১ম ভাগে পানি বেশি থাকে যা শিশুর তৃষ্ণা মেটাবে।
· ২য় ভাগে চর্বি ও ক্যালরী বেশি থাকে যা শিশুর ক্ষিধা মেটাবে।
শাল দুধঃ শিশুর জন্মের প্রথম কয়েকদিন যে ঘন আঠালো হলুদাভ দুধ পাওয়া যায় তাহাই শাল দুধ। এটি শিশুর প্রথম টিকা কারণ এতে রোগ প্রতিরোধক অনেক উপাদান থাকে। কিন্তু কুসংষ্কারের কারনে অনেক শিশু শাল দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। মনে রাখবেন জন্মের প্রথম ৬মাস শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ পান করাবেন। মায়ের দুধ ব্যতিত কিছুই খাওয়ানো যাবেনা এমন কি একফোটা পানিও না। কিন্তু আমাদের সমাজে শিশুকে জন্মের পর মধু, পানি, তেল, চিনির পানি ইত্যাদি খাওয়ানোর প্রচলন দেখা যায় যা নবজাতকের মৃত্যুর জন্য দায়ী কারণঃ
v এটি নবজাতককে শালদুধ থেকে বঞ্চিত করে।
v নবজাতক অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
v নবজাতকের ক্ষুধা নষ্ট করে তাকে মায়ের দুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখে।
v আর যদি ফিডার ব্যবহার করা হয় তবে শিশু মায়ের দুধ চুষতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের উপকারিতা
১. মায়ের দুধে শিশুর বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য পরিপূর্ণ পুষ্টিমান নিশ্চিত থাকে।
২. মায়ের দুধ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মুক্ত, খাঁটি এবং পরিচ্ছন্ন। ফলে শিশুর রোগাক্রান্ত হবার ভয় নেই।
৩. বুকের দুধে থাকে অ্যান্টিবডি, এনজাইম এবং ভিটামিন, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
৪. শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ যেমন: ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানপাকা মেনিনজাইটিস ইত্যাদি থেকে রক্ষা পায়।
৫. বুকের দুধে লিনোলেনিক এসিড, ওমেগা-৩, ফ্যাটি এসিড এবং কোলেস্টেরল বিভিন্ন উপাদান থাকে; যা শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে সাহায্য করে। এতে শিশু মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয়।
৬. মায়ের দুধ শিশুকে ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্থুলতা থেকে রক্ষা করে।
৭. বিশেষ কিছু রোগ যেমন: হাঁপানি, এলার্জি, একজিমা, দাঁতের অসুখ ইত্যাদি রোধে মায়ের দুধের ভূমিকা ব্যাপক।
৮. মায়ের দুধে থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি, যা শিশুকে অন্ধত্ব ও স্কার্ভি থেকে রক্ষা করে।
৯. মায়ের শাল দুধ শিশুর প্রথম প্রাকৃতিক টিকা হিসেবে কাজ করে।
১০. যে সব শিশু ঠিক মতো মায়ের দুধ পান করে তারা স্বাস্থ্যবান ও দ্রুত বেড়ে উঠে।
মায়ের দুধ পান করানোর মাধ্যমে মা নিজেই বেশ কয়েকটি শারীরিক এবং মানসিক উপকারিতা পান। মায়ের দুধ শুধু শিশুর জন্যই উপকারী নয়, বরং মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মা দুধ পান করালে যে উপকারিতা পান
১. সদ্যভূমিষ্ট শিশু নাড়ী কাটার আগেই যদি মায়ের দুধ পান করে, তাহলে গর্ভস্থফুল বা প্লাসেন্টা দ্রুত বের হয়ে আসে। ফলে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমে যায়।
২. শিশুকে ঠিক মতো বুকের দুধ খাওয়ান, এমন মায়ের স্তন ও জরায়ু ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
৩. বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় প্রোলাকটিন নামে এক ধরনের হরমোন মায়ের ডিম্বাশয়ের কার্যপ্রণালিতে বাধা দেয়। ফলে দুধ পান একটি প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে।
৪. বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে স্তনের টিস্যুগুলোর ব্যায়াম হয়, বিধায় স্তন সুডৌল থাকে।
৫. বুকের দুধ তৈরি হতে শরীরের অভ্যন্তরে প্রতিদিন অতিরিক্ত ক্যালরি খরচ হয়, ফলে মায়ের শরীরে থাকা অতিরিক্ত মেদ কমে যায়, এতে শরীর দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
৬. দুধ দেওয়ার মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়। এতে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক।
৭. মায়ের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে মায়ের মধ্যে অক্সিটোসিনের নিঃসরণ হয়, যা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি হতাশা এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
নবজাতকের জন্য মায়ের দুধ একান্ত অপরিহার্য। এটি শিশুর প্রথম এবং সর্বোত্তম খাদ্য, যা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সামগ্রিক সুস্থতায় সহায়ক। প্রথম ছয় মাসে একমাত্র মায়ের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট এবং ছয় মাসের পরেও এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে সম্পূরক খাবারের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত। মায়ের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে আমরা নবজাতকের সঠিক বিকাশ এবং সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।