গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট এর উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। এই চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে তা আপনার ও গর্ভের শিশুর দেহে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে—
- গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া)। অ্যানিমিয়া একটি সাধারণ সমস্যা যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হলে যে-সব লক্ষণ দেখা দেয়—
- ক্লান্ত অনুভব করা
- শরীরের শক্তি কমে যাওয়া অথবা দুর্বল লাগা
- শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা
- বুক ধড়ফড় করা
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা থেকে ‘পিকা’ নামের একটি সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা হলে খুবই অদ্ভুত জিনিস, অর্থাৎ খাবার নয় এমন কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয়। যেমন: মাটি, কাগজ কিংবা দেয়ালের রং। এমন বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- এ ছাড়াও গর্ভকালীন আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবে গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে আপনার শিশু জন্মের সময়ে এবং জন্মের পরেও বেশ কিছু সমস্যায় ভুগতে পারে। যেমন—
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই, অর্থাৎ প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেওয়া
- জন্মের সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন হওয়া
- শিশুর স্বাভাবিক ব্যবহারগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া
- শিশুর শরীরে আয়রনের মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে কম হওয়া
গর্ভাবস্থায় আয়রনযুক্ত খাবার খাওয়ার পাশাপাশি বাড়তি আয়রনের চাহিদা মেটাতে নিয়মমতো আয়রন ট্যাবলেট সেবন করলে তা মা ও গর্ভের শিশুকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় কতটুকু আয়রন ট্যাবলেট খাবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মতে, গর্ভাবস্থায় আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। তবে এটি নির্ভর করে মায়ের শারীরিক অবস্থা এবং রক্তশূন্যতার মাত্রার ওপর। ডাক্তার নির্দিষ্ট পরীক্ষার ভিত্তিতে সঠিক ডোজ নির্ধারণ করবেন।
বাংলাদেশে গর্ভকালীন সময়ের জন্য আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। এতে গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক পরিমাণে আয়রন যোগ করা থাকে। সেই সাথে ফলিক অ্যাসিড থাকে, যা শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে এবং নানান জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে।
উল্লেখ্য, আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার মতো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে ৬০ মিলিগ্রামের বেশি ডোজে আয়রন সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন
গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট কখন ও কীভাবে খাবেন ?
গর্ভাবস্থার শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। সন্তান জন্মদানের তিন মাস পর পর্যন্ত আয়রন সেবন চালিয়ে যেতে হবে।
আয়রন ট্যাবলেট খাবার নিয়ম
আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খালি পেটে খেলে এটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে। তাই খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা খাবার শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা পরে এক গ্লাস পানির সঙ্গে এই ট্যাবলেট গ্রহণ করা উচিত। পানির পরিবর্তে এক গ্লাস কমলার রস বা লেবুর শরবতও ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ এতে থাকা ভিটামিন সি শরীরকে আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
তবে, খালি পেটে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খেলে অনেকের ক্ষেত্রে পেটে অস্বস্তি হতে পারে। যদি এমন হয়, তাহলে ডাক্তার আপনাকে খাবারের সাথে বা খাওয়ার পরপরই ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
সতর্কতা
আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের সাথে একই সময়ে অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাবেন না। এতে আয়রনের কার্যকারিতা কমে যায়। অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে আয়রন ট্যাবলেট খাবেন।
এ ছাড়াও কিছু কিছু খাবার শরীরে আয়রন শোষণের হার কমিয়ে ফেলতে পারে। আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার সময়ে এসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এমন কিছু খাবার হলো—
- চা ও কফি
- ডিম
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- সয়াবিনযুক্ত খাবার
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ক্ষেত্রে যে চারটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে —
- আপনি আগে থেকেই শুধুমাত্র আয়রন অথবা কোনো মাল্টিভিটামিন সেবন করে থাকলে, তা ডাক্তারকে জানাবেন৷ ডাক্তারের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়া কয়েক ধরনের মাল্টিভিটামিন, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে সেবন করা থেকে বিরত থাকবেন।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন সময়ে যে-সব মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়, সেসবে আয়রন যোগ করা থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় ডাক্তার আপনাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকলে আলাদা করে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন নেই।
- গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। এই ট্যাবলেট গর্ভাবস্থায় একই সাথে আয়রন ও ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ করে। তাই এটি সেবন করলে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন (যেমন: আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা) ছাড়া আলাদা করে শুধু আয়রন ট্যাবলেট অথবা সিরাপ সেবনের প্রয়োজন নেই।
- নিয়মিত ‘আয়রন-ফলিক অ্যাসিড’ ট্যাবলেট সেবনের পরেও আপনার রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করাবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।
- গর্ভাবস্থায় আপনি অন্য যেকোনো ঔষধ সেবন করলে ডাক্তারকে সেই ঔষধের নাম ও ডোজটি জানান। অনেকসময় আয়রনের সাথে অন্যান্য ঔষধের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডোজ কমানো কিংবা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আয়রন ট্যাবলেট এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে হতে পারে। যেমন—
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- পাতলা পায়খানা
- পেট ব্যথা
- অ্যাসিডিটি, বুক জ্বালাপোড়া করা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
- বমি বমি ভাব ও বমি
- কালচে পায়খানা
- ড্রপের ক্ষেত্রে দাঁত কালচে হয়ে যাওয়া
যদিও খালি পেটে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া ভালো, তবুও পেট ব্যথা কিংবা পাতলা পায়খানার সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য খাবারের সাথে অথবা খাওয়ার ঠিক পর পরই আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাবেন। এতে করে আয়রন ট্যাবলেটজনিত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কিছুটা কমতে পারে।
তবে আপনার এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাওয়া বন্ধ করবেন না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও এই ঔষধ সেবন চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। আপনার যদি খুব বেশি সমস্যা বা অস্বস্তি হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। ডাক্তার আপনাকে অন্য ব্র্যান্ডের ঔষধ কিংবা ট্যাবলেটের বদলে ইনজেকশন হিসেবে আয়রন গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারে। তবে নিজে নিজে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বদল করে ফেলবেন না। এ ছাড়াও যদি আপনার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দেয় তাহলে ঔষধ সেবন বন্ধ করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
Pingback: গর্ভাবস্থায় ঔষধ সেবনে সচেতনতা — Parenting Point